সরকারি বাসা ভাড়া দিয়ে নগদ টাকা গুনে রেলের ডিসিও আনসার আলী পর্ব-২

Passenger Voice    |    ০৮:০৯ পিএম, ২০২১-০২-০৬


সরকারি বাসা ভাড়া দিয়ে নগদ টাকা গুনে রেলের ডিসিও আনসার আলী পর্ব-২

সামসুদ্দীন চৌধুরীঃ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বরাদ্দকৃত বাসা ব্যবহারের বিষয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের তাদের জন্য তৈরি করা বাসাতেই থাকতে হবে। বাসা বরাদ্দ নিয়ে যদি কোনো কর্মকর্তা সেখানে না থাকেন, তাহলে ওই কর্মকর্তা বাসাভাড়া ভাতা পাবেন না। সাম্প্রতিক জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী এই নির্দেশ দেন। একনেক বৈঠক শেষে পরিকল্পনা সচিব আসাদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত বাসা রয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তাঁরা সেসব বাসায় থাকেন না। সরকারি বেতন বৃদ্ধির ফলে এখন যে বাসা ভাড়া পাওয়া যায়, সেটার চেয়ে কম পয়সায় বাইরে বাসা ভাড়া পাওয়া যায়। ফলে তাঁরা বাইরে থাকেন। এ জন্য সরকারি টাকায় তৈরি বাসাগুলো অব্যবহৃত থাকে। নষ্ট হয়ে যায়। যাঁদের নামে বাসা বরাদ্দ হবে, বিশেষ করে নির্ধারিত বাসাগুলোতে তাঁদের থাকতেই হবে। যদি না থাকেন, তাহলে বাড়িভাড়া বাবদ যে ভাতা পান, তা পাবেন না। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। 

তবে গাছের উপরে খায় নিচে পোড়াবে এমন বুদ্ধিতে রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের কতিপয় কর্মকর্তা। তারা সরকারি বাসা বরাদ্ধ নিয়ে সে বাসা অন্যের কাছে ভাড়া দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে অন্যদিকে আরো কম টাকার বাসায় বসবাস করছে তাঁরা। শুধু নিজের বাসা নই, কর্মকর্তাদের গাড়ির চালক ও অফিস পিয়নের জন্য বরাদ্ধকৃত বাসাও ভাড়ায় খাটায় কতিপয় কর্মকর্তা। বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার কার্যালয় ঘিরে চলমান অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে প্যাসেঞ্জার ভয়েসের পাঁচ পর্বের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব “দুর্নীতির বাহুবলে রাঘববোয়াল পূর্বরেলের ডিসিও আনসার আলী” শিরোনামে গত ২ ফেব্রুয়ারী প্রকাশ হয়, আজ তাঁর ২য় পর্ব।

সূত্র বলছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের পাহাড়তলি হাসপাতাল কলোনির এমও২ নং বাংলোটি রেলওয়ে থেকে বরাদ্দ দিয়েছে চট্টগ্রাম রেলের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আনসার আলীর নামে। সূত্রের দেওয়া তথ্য যাচাই করতে গতকাল শুক্রবার বিকেলে আনসার আলীর খোঁজে এই বাংলোতে যায় প্যাসেঞ্জার ভয়েস। অথচ সেখানে গিয়ে দেখা যায় এই বাংলোতে তিনি থাকেন না। রেলের সাবেক লোকোমাষ্টার কবিরকে মাসে ১৫ হাজার টাকায় বাসাটি ভাড়া দিয়েছে।

উক্ত বাংলোতে লোকোমাষ্টার কবিরের স্ত্রী, সন্তানদের পাওয়া যায়। তাদের কাছ থেকে খবর নিয়ে পাহাড়তলি লোকোসেডের সামনে কবিরের দোকানে তাঁর সাথে দেখা করে প্যাসেঞ্জার ভয়েস। কবিরের দেয়া তথ্যও মিলে যায় সূত্রের দেয়া তথ্যের সাথে। জানা যায়, ডিসিওর গাড়ি চালক ও অফিস পিয়নের জন্য তার বাংলোতে দুই ইউনিটের একটি ঘর ছিল। এইঘর গুলোও ডিসিও আনসার আলী  তিন ইউনিট করে বহিরাগত তিন পরিবারের কাছে ১১ হাজার টাকায় ভাড়া দিয়েছেন। এবার ডিসিও আনসার আলীর বসবাসের বাসা খোঁজতে যায় প্যাসেঞ্জার ভয়েস। নগরীর ফয়েসলেক রোজভ্যালি আবাসিক এলাকায় আহমেদ ভিলা নামের ৮ তলা ভবনের ৬ষ্ট তলায় ২২ হাজার ৫০০ টাকা ভাড়ায় থাকেন তিনি। এই বাড়িটির নিচে ডিসিও আনসার আলীর সরকারী ব্যবহৃত গাড়িটি ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-২৯২৯ পাওয়া যায় । 

বাংলাদেশ বরাদ্দ বিধিমালা-১৯৮২ ও প্রস্তাবিত ২০১৭ বিধিমালা অনুযায়ী কোন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারের বাসা বরাদ্দ নিয়ে কাউকে ভাড়া ও সাবলেট ভাড়া প্রদান করতে পারবেন না। যদি কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী এমন অপরাধ করে তাহলে সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার আওতায় তার বিরুদ্ধে শৃংখলা ভঙ্গের জন্য শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এবং বাসাটি কর্তৃপক্ষ উদ্ধার করে উদ্ধারের তারিখ থেকে পরবর্তী দুই বছর তিনি সরকারী বাসা বরাদ্ধ পাওয়ার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ থাকবেন। এমন কঠিন আইন থাকলেও রেলের বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তা হওয়ায় এত দিনেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। 

তবে বাসা বরাদ্দ নিয়ে এমন অনিয়মে জড়িত রয়েছে বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আনসার আলীর প্রধান সহকারী (বড়বাবু, ডিসিও স্টোর) মো. জাকির হোসেন। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে সরকারি বাসা বরাদ্দ নিয়ে আশে পাশে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে ভাড়া বাণিজ্যের অভিযোগ। জানা যায় নগরীর পাহাড়তলীতে একটি  বাসা বরাদ্দ নিয়ে তার চারপাশে বেশ কয়েকটি ঘর নিমার্ণ করে বহিরাগতদের কাছে ভাড়া দিয়েছে জাকির হোসেন। ডিসিও আনসার আলীর ছত্রছায়ায় থাকার কারনে এই কর্মচারীর অবৈধ স্থাপনার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারে না কর্তৃপক্ষ- এমন অভিযোগ ডিসিও অফিসের কর্মচারীদের। তবে অভিযোগ আছে বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার হয়ে বিভিন্ন স্থানে নানান অনিয়ম করেন তিনি। এমনকি তিনি ডিসিও আনসার আলীর ক্যাশিয়ার হিসেবেও অনেকের কাছে পরিচিত। 

এই বিষয়ে ডিসিও স্টোরের প্রধান সহকারী জাকির হোসেনকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, আমি এমন কোন অনিয়মের সাথে জড়িত না। এছাড়া তিনি প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও হুমকি প্রদান করে। 

অন্যদিকে গত বছরের অক্টোবর মাসের নগরীর ষোলশহর ষ্টেশনের টি-১৩/বি নম্বরের এ টাইপ ক্যাটাগরির একটি বাসা বরাদ্দ দিতে গিয়ে ডিসিও আনসার আলী অনিয়ম করেছেন বলে অভিযোগ রেলের  ট্রাফিক বিভাগের কর্মচারীদের।

সূূত্র বলছে, রেলের বাসাগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয় ইঞ্জিনিয়ারিং কোড অনুসারে। নিয়ম অনুযায়ী ট্রাফিক পুলে ডিসিওর অধীনে কোন বাসা খালী হলে বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা সে বাসাটি পুনরায় বরাদ্দ দেয়ার জন্য তার দপ্তরের আগ্রহী প্রার্থীদের আবেদন করার জন্য চিঠি ইস্যু করবে। ডিসিও দপ্তর থেকে কোন আবেদনকারী পাওয়া না গেলে প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা সিসিএম তার অধিনস্ত কর্মচারীদের আবেদন করার জন্য চিঠি ইস্যু করে থাকে।  তিনিও কোন আবেদনকারী না পেলে ডিটিও অপারেশনাল বিভাগের কর্মচারীদের খালী বাসার সম্পর্কে অবগত করবে। সেখানেও যদি প্রার্থী না থাকে তাহলে আগ্রহী প্রার্থীর আবেদনের জন্য সিওপিএস এই বিষয়ে চিঠি ইস্যু করবে। এবং ট্রাফিকের কোথাও যদি আবেদনকারী না পাওয়া যায় তখন প্রকৌশল বিভাগের কাছে বাসাটি হস্তান্তর করতে পারবে।

তবে আইনে এমন বলা থাকলেও ষোলশহরের এই বাসাটি (টি-১৩/বি) পূর্বের বরাদ্দকৃত কর্মচারী টিটিই আবু জাফর ছেড়ে দিলে এ বিষয়ে নতুন আবেদনকারীদের অবগত করার জন্য ডিসিও আনসার আলী প্রকাশ্যে কোন চিঠি ইস্যু করেনি। তবে গত রবিবার প্যাসেঞ্জার ভয়েসের কাছে আনসার আলী দাবী করেছেন তিনি চিঠি ইস্যু করেছে। কিন্তু কোন প্রার্থী পায়নি।

তবে ডিসিও অফিসের অধীনে বাসাটি নেওয়ার জন্য কোন প্রার্থী না পেয়ে তিনি এ বিষয়ে সিসিএম কে কেন অবগত করেনি এমন প্রশ্নের তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেনি। এদিকে ট্রাফিক পুলের এই বাসাটি নিয়মবহির্ভূত ভাবে প্রকৌশলী বিভাগের এক কর্মচারীর নামে তিনি বরাদ্দ দেন। এই সময়ে একটি মোটা অংকের টাকাও লেনদেন হয়েছে বলে লোকমূখে অভিযোগ শোনা যায়। 

বিষয়টি নিশ্চিত হতে বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আনসার আলীর বক্তব্য গ্রহনের জন্য আজ বিকেলে তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে ফোন করা হলে প্যাসেঞ্জার ভয়েসের প্রতিবেদক পরিচয় পাওয়ায় পর তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এরপর আরো কয়েকবার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি। 

আরও পড়ুন >>> রেলের কেনাকাটায় হরিলুট: কব্জির জোরে বহাল দুর্নীতিবাজরা

আরও পড়ুন>>> এক ডজন দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে রেলের ডিজি শামসুজ্জামানের বিদায়