দুর্নীতির বাহুবলে রাঘববোয়াল পূর্বরেলের ডিসিও আনসার আলী পর্ব-১

Passenger Voice    |    ০৮:০৫ এএম, ২০২১-০২-০২


দুর্নীতির বাহুবলে রাঘববোয়াল পূর্বরেলের ডিসিও আনসার আলী পর্ব-১

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ করোনার মহামারিতেও দুর্নীতির বাহুবলে শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখনও নানান রকম অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। করোনা কালে ২৯ দুর্নীতিবাজকে দেশের মানুষের কাছে রেলওয়ের তদন্ত টিম পরিচয় করিয়ে দিলেও রয়ে গেছে আরো অনেক রাঘববোয়াল। প্যাসেঞ্জার ভয়েসের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় ২০২০ সালে বছর জোড়ে বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার অফিস সহকারীদের রেলের গার্ড প্রশিক্ষণে মোটাদাগে অনিয়ম, দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় ২৪ জন গার্ড প্রশিক্ষণে একটি মোটা লেনদেনের সত্যতা পাওয়া যায় বিভাগীয় বাণ্যিজিক কর্মকর্তা মো. আনসার আলীর বিরুদ্ধে। তবে ঘুষ দেওয়া নেওয়া দুইটি অপরাধ হওয়ায় এই বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে নারাজ, তবে কানাঘোষা করে রেলের ভাবমূর্তি চরমভাবে নষ্ট করছে অনেকে। বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার কার্যালয় ঘিরে চলমান অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে প্যাসেঞ্জার ভয়েসের পাঁচ পর্বের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের আজ প্রথম পর্ব।

সূত্র বলছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের জুনিয়র ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (জেটিআই) পদে পদোন্নতি পরীক্ষায় ব্যাপক অনিয়ম রেলের নিজস্ব তদন্তে প্রমানিত হয়। ২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের (৫৪.০১.০০০০.০০৫.২৭.০০২.১২.১১৯) নং স্বারকমূলে উপ-পরিচালক/ই-২ কামাল শেখ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) বরাবর ১৩ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদনে রেলের তিন যুগ্ম-মহাপরিচালক এর সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি পদোন্নতি পরীক্ষায় নির্বাচনী কমিটির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের দায়ী করে বিভাগীয় শাস্তির কথা বলেছিল। এই ঘটনায় স্বশরিরে জড়িত ছিলেন পূর্ব রেলের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আনসার আলী। আলোচিত সেই ২০১৭ সালে তিনি পূর্বাঞ্চল রেলের ডেপুটি সিওপিএস থাকাকালীন জেটিআই পদোন্নতি পরীক্ষায় দায়িত্ব পালনে তার চরম অবহেলা ও গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছিল তদন্ত কমিটি। তবে এখানে থেমে ছিলেন না তিনি, লিখিত পরীক্ষায় পদোন্নতির আবেদনকারীদের ১০ জনকে অতিরিক্ত নম্বর দিয়েও অপকর্ম করেছিলেন।  পরে এই ঘটনায় সরকারী কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর ৩ (খ) বিধি অনুযায়ী অসদাচরণ এর অভিযোগে বাংলাদেশ রেলওয়ে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করে। মামলা নং-০৩/২০১৮। মামলা দায়েরের পরে ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ৫৪.০০.০০০০.০২৩.২৭.০১২.১৮-৩০৪ নং স্বারকযোগে অভিযোগ নামা ও অভিযোগের বিবরণী আনসার আলীর কাছে পাঠিয়ে ব্যক্তিগত শুনানী চান কিনা জানতে চাই কর্তৃপক্ষ।  পরে অভিযুক্ত আনসার আলী একই বছরের ১১ অক্টোবর লিখিত জবাব দাখিল করে ব্যক্তিগত শুনানীর জন্য আবেদন করলে তা ১৪ নভেম্বর গ্রহন করা হয়। 

সূত্র আরো বলছে, এমন অপকর্ম তিনি মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে করেছেন। তবে বিষয়টি বাংলাদেশ রেলওয়ের তিন যুগ্ম মহাপরিচালক তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছিল, আর্থিক/ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন/২০১২ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন আইন/২০০৪ এর আওতায় তদন্তযোগ্য বলে তাঁরা ঘুষ দুর্নীতির তদন্ত করতে পারেনি। তবে রেল কর্তৃপক্ষ সচ্চতা রক্ষায় ও আনসার আলীকে সুবিচার প্রদানে বিভাগীয় মামলাটি আবারও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক উপ সচিবকে দিয়ে তদন্ত করালে ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়ে রেলের ভাবমূর্তি ফেরাতে স্বপ্রনোদিত হয়ে ডাকেনি দুর্নীতি দমন কমিশন দুদককে। ফলে এই বিষয়টিকে রেলের কালোবিড়াল খামারের রাখার পদ্ধতি বলে মন্তব্য করেছে বিশ্লেষকরা।

রেলে দুর্নীতিবাজদের দৃশ্যমান কোন শাস্তি হয়না এইটা জনমুখে রচিত একটি চলমান বাক্য। আনসার আলীও একই পথে পার হয়ে যায়। সূত্র বলছে আনসার আলীকে এই পথ পাড়ি দিতে রেলের বরিশাল সিন্ডিকেটটি কাজ করেছিল। সে সিন্ডিকেট এর সক্রিয় সদস্য হওয়ায় কৌশলে নিজের পক্ষে সাফাই লিখিয়ে নিয়েছিলেন দ্বিতীয় তদন্তকারী কর্মকর্তাকে দিয়ে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করে তাহলে আগের তদন্তকারী তিন যুগ্ম মহাপরিচালকরা কি এতোই অদক্ষ ছিল যে সামান্য একটি পদোন্নতির পরীক্ষায় অনিয়মের সঠিক তদন্ত করতে পারেনি। যদি এমন হয় তাহলে ভুল তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে জুনিয়র কর্মকর্তাকে হয়রানি করায় তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি? 

অন্যদিকে দ্বিতীয় তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-সচিব এর তদন্ত যদি সঠিক হয় তাহলে আগের তদন্তের সময় পদোন্নতি পরীক্ষার খাতায় অতিরিক্ত নম্বর পাওয়া সেই খাতা গুলো হয়তো পরিবর্তন করে নতুন খাতা যুক্ত করিয়ে তদন্তে প্রভাব বিস্তার করেছিল কেউ- এমন অভিযোগও রেল অঙ্গনে। 

এই বিষয়ে জানতে চাইলে ডিসিও আনসার আলী বলেন, আমার রিরুদ্ধে যে তদন্ত হয়েছিল প্রথম রির্পোটটি মিথ্যা ছিল। বিষয়টি অফিসিয়ালি সচিব স্যার (তৎকালীন রেলের সচিব মোফাজ্জল হোসেন)  বলেছেন।

তবে পূর্বের রির্পোটটি মিথ্যা থাকার বিষয়ে তিনি কোন পত্র প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে দেখাতে পারেনি। 

বিষয়টি খোলাসা করে জানতে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মোফাজ্জল হোসেন কে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে এইসব অনিয়ম ও ঘুষ দুর্নীতির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে দিয়ে তদন্ত করিয়ে রেলের ভাবমূর্তি ফেরানোর এখনই সময়।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছে, এই অনিয়ম দুর্নীতির দৃশ্যমান শাস্তি হলে তাহলে হয়তো আনসার আলীর লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হতো। ক্ষমা পেয়ে বেপরোয়া গতিতে দুর্নীতির রাঘববোয়াল হওয়া সম্ভব হতো না তার পক্ষে।

এদিকে রেলের একটি সুত্র জানায় ২০১৯ সালের শেষের দিকে রেলের গার্ড প্রশিক্ষনে ব্যাপক অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন পূর্বাঞ্চল রেলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা নাছির উদ্দিন ও বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আনসার আলী। ১৯৮৫ সালের নিয়োগ বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার অফিসে কর্মরত শুধুমাত্র অফিস সহকারীদের প্রশিক্ষণ নিয়ে গার্ড পদে পদোন্নতি দেয়ার কথা থাকলেও অদৃশ্য কারনে আনসার আলী বুকিং সহকারী,পার্সেল সহকারী, গুডস সহকারী ও টালি সহকারীকে গার্ড প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেয়। এছাড়া কর্তৃপক্ষের চাহিদার চেয়েও অতিরিক্ত কর্মচারী ট্রেনিং এর জন্য পাঠিয়েছিলেন তিনি। যা নিয়ে সে সময়ের রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমির রেক্টর আনোয়ার হোসেনও অসস্থিতে পড়েছিলেন। একইভাবে দুর্নীতি করেছিল সে সময়ের পূর্ব রেলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা নাছির উদ্দিন যা পত্রিকার পাতায়ও ফলাও করে ছাপিয়েছিল গণমাধ্যমকর্মীরা। তবে কব্জিরজোড় কম থাকায় নাছিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও স্বপদে বেপরোয়া গতিতে ছিলেন আনসার আলী।

এদিকে রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমির সিনিয়র ট্রেনিং অফিসার (ট্রাফিক) আবুল কাশেম প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন,২০২০ সালে বছর জোড়ে বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ২৪ জনকে গার্ড প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়েছে আনসার আলী। তাদের মধ্যে অফিস সহকারী ছাড়া ডিসিওর অধীনে থাকা বুকিং সহকারী,পার্সেল সহকারীও ছিল। 

রেল সংশ্লিষ্টরা বলছেন নিয়োগ বিধি উপেক্ষা করে কর্তৃপক্ষের চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত লোক পাঠানো ও অফিস সহকারীকে বাদ দিয়ে অন্য পদ থেকে গার্ড ট্রেনিং এ পাঠানো সম্পূর্ণ বেআইনী যার ফলে তাদের পেছনে ট্রেনিং বাবদ লাখ লাখ টাকা রেলওয়ের ক্ষতি হচ্ছে। এর দায়ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নিতে হবে। গার্ড প্রশিক্ষনের সুবিধা কি এমন প্রশ্নের জবাবে পরিবহন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন,কর্মচারিরা প্রশিক্ষণ নিয়ে গার্ড হলে প্রতি টিপে মাইলেজ পেয়ে থাকে তাই প্রশিক্ষনে আগ্রহী অনেকে।

এদিকে ডিসিও অফিসের একটি সূত্র বলছে কর্মচারিদের এই আগ্রহ কাজে লাগিয়ে একটি চক্র তদবির বাণিজ্যের নামে প্রার্থীদের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে ঘুষ গ্রহন করে থাকে। কর্মচারীরাও প্রতি টিপে মাইলেজ পাওয়ার আশায় প্রশিক্ষনের তদবিরে টাকা ঢেলে পার হওন।

দুর্নীতিবাজদের বাহুবলে থাকা পূর্বাঞ্চল রেলের সিন্ডিকেট ভাংতে সাম্প্রতিক সময়ে রেলের দক্ষ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেনকে মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। তবে মহাব্যবস্থাপক দুর্নীতিবাজদের লাগামটানার চেষ্টা করলেও কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারনে মাঠ পর্যায়ের তথ্য গুলো পূর্ব রেলের হেডকোয়াটার্স পর্যন্ত পৌছেনা বলে মনে করছেন রেল বিশ্লেষকরা। তাই দুর্নীতি হ্রাসে মহাব্যবস্থাপকের সদিচ্ছা থাকলেও অনেক তথ্যই অজানা থেকে যায় তার কাছে।