দুর্নীতির রুই-কাতলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না: প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে ড. ইফতেখারুজ্জামান

রেলের কেনাকাটায় হরিলুট: কব্জির জোরে বহাল দুর্নীতিবাজরা

Yasin Hoque    |    ০৪:৪৪ পিএম, ২০২০-০৯-২৫


রেলের কেনাকাটায় হরিলুট: কব্জির জোরে বহাল দুর্নীতিবাজরা

ইয়াছিন হক: ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভিন্ন স্টেশনের মালপত্র কেনাকাটায় চলেছে হরিলুট। চলতি বছরের শুরুর দিকে পরিবহন অডিট অধিদপ্তর রেলওয়ের বিভিন্ন মাল কেনাকাটাসহ অন্যান্য বিষয়ে নিরীক্ষা করে। এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনের কপি প্যাসেঞ্জার ভয়েস ঘেঁটে ঘুঁটে জানতে পারে চাঞ্চল্যকর তথ্য। 

সাম্প্রতিক সময়ে পরিবহন অডিট অধিদপ্তর থেকে রেল মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমাও দেওয়া হয়েছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকশীর বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা ডিসিওর চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন স্টেশনে লেভেলক্রসিং গেটে ব্যবহারের জন্য তালা, বালতি, ঝাণ্ডা ও বাঁশি কেনা হয়েছে। এইসব মালামাল উচ্চমূল্যে ক্রয় করে সরকারের ২৬ লক্ষ ৭৩ হাজার ৮৫০ টাকার আর্থিক ক্ষতি করেছে রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তারা। এমনকি এই দুর্নীতির সাথে জড়িত রয়েছে,  এই ক্রয় সংক্রান্ত বাজার যাচাই কমিটি, এস্টিমেট/প্রাক্কলন প্রণয়নকারী, এস্টিমেট অনুমোদনকারী, টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি ও টেন্ডার মূল্যায়নের সুপারিশ অনুমোদনকারী এবং তাঁদের আস্তাভাজন ঠিকাদার। 

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় এই চক্রটি রেলওয়ে ঘুনটি ঘরে ব্যবহারের জন্য একটি তালা পাঁচ হাজার ৫৯০ টাকায়, প্রতিটি বালতি এক হাজার ৮৯০ টাকায়, প্রতি হুইসেল বাঁশি ৪১৫ টাকায় এবং হাত ঝাণ্ডা এক হাজার ৪৪০ টাকায় কিনেছেন। অথচ অডিট টিম বাজার ঝাচাই করে দেখতে পায়, একটি তালার বাজার মূল্য ১৫০ টাকা, বালতির বাজার মূল্য ৩০০ টাকা, একটি হুইসেল বাশিঁর বাজার মূল্য ৫০ টাকা এবং একটি হাত ঝান্ডার বাজার মূল্য ১৬০ টাকা। প্রতিটি পণ্যের উপর ৩০ % ভ্যাট, আইটি, সরবরাহকারী মুনাফা এবং আনুষঙ্গিক খরচ সহ প্রাক্কলিত মূল্য দাঁড়ায় তালা ১৬৫ টাকা, বালতি ৩৯০ টাকা, প্রতিটি বাঁশি ৬৫ টাকা, প্রতিটি হাত ঝান্ডা ২০৭ টাকা। উল্লেখিত মালামালের মধ্যে শুধু তালা বাজার মূল্যের ৩৩ গুন উচ্চমূল্যে ক্রয় করে সরকার তথা জনগণের রাজস্বের ১৮ লক্ষ ১৮ হাজার ৯০০ টাকা মেরে দিয়েছে চক্রটি। 

সরকারি মালামাল কেনাকাটার বিষয়ে জিএফআর বিধি-১১ এ বলা হয়েছে- প্রত্যেক বিভাগীয় প্রধান প্রতিটি ক্ষেত্রে আর্থিক শৃঙ্খলা এবং কঠোর মিতব্যয়িতা প্রতিষ্ঠার জন্য দায়ী। তিনি তাহার নিজের অফিস এবং তাঁহার অধস্তন ব্যয়ন কর্মকর্তাগণ যাহাতে আর্থিক বিধি-বিধান অনুসরণ করেন তার জন্য দায়ী। এ ক্ষেত্রে  আলোচ্য বিধিগুলো পরিপালন না করে অমিতব্যয়িতার সাথে সরকারি অর্থ খরচ করা হয়েছে।

রেলের ট্রাফিক বিভাগের কেনাকাটার নিয়ম যেভাবে:

বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা ডিসিও ও বিভাগীয় পরিবহন সুপারেনটেনডেন্ট ডিটিএস তার দপ্তরের প্রয়োজনীয় মালামাল ক্রয়ের জন্য প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা সিসিএম বরাবরে মালামালের চাহিদা প্রদান করে থাকেন। সিসিএম চাহিদাপত্রটি অগ্রবর্তী করে সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক বরাবরে পাঠানো হয়ে থাকে। এছাড়াও ডিসিও-ডিটিএস নিজেরাও চাহিদাপত্র সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক  কে দিতে পারে।  কেনাকাটার বাকি সকল দায়িত্ব সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক এর দপ্তরের।

১৫০ টাকার তালা ৫৫৯০ টাকায় ক্রয় করার এই দুর্নীতির সময়কালে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের ডিসিও ছিলেন আনোয়ার হোসেন, ডিটিএস মো. শওকত, প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা সিসিএম  এর দায়িত্বে ছিলেন এ এস এম শাহনেওয়াজ, সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক এর দায়িত্বে ছিলেন বর্তমান রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সিওএস বেলাল হোসেন সরকার। 

এদিকে জিএফআর বিধি-১১ মোতাবেক প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে থাকায় এ এস এম শাহনেওয়াজকে চট্টগ্রামের চীফ অপারেটিং সুপারেনটেনডেন্ট এর দায়িত্ব থেকে ওএসডি করা হয়। কিন্তু নিরিক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখিত আছে মালামালের বাজার যাচাই, এস্টিমেট/প্রাক্কলন প্রণয়নকারী, টেন্ডার আহব্বান ও পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করাসহ সকল কার্যক্রম সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক সিওএস বেলাল হোসেন সরকার এর দপ্তরে হয়। তবে এখনও পযন্ত এই সিওএস ক্ষমতার বলয় ব্যবহার করে নিজের চেয়ারে বহাল তবিয়তে থাকলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।  এছাড়া পশ্চিমাঞ্চলের রেলে অস্বাভাবিক দরে মালামাল ক্রয় করলেও বাজার যাচাই কমিটি, এস্টিমেট/প্রাক্কলন প্রণয়নকারী ও পণ্যের মূল্য নির্ধারণকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বিষয়টি জানতে সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক সিওএস বেলাল হোসেন সরকার এর ০১৭১১-৬---৫২, ০১৭৫২-৯---১৮ মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেস্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোন উত্তর দেননি।

কেনাকাটায় দুর্নীতি কেন বন্ধ করা যায় না?
দুর্নীতি বিষয়ে বহু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একাধিক রিপোর্ট করেছে টিআইবি এবং তার প্রকাশও করা হয়েছে অনেক আগে। তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি কেনাকাটায় প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত সব কর্মকর্তা টপ-টু-বোটম সবাই দুর্নীতির সাথে জড়িত। যার কারণে এ খাতে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব হয় না।"
"যেহেতু দুর্নীতি করলে পার পাওয়া যায় আর এই ধরণের নিরাপত্তা নিয়ে অর্থাৎ দুর্নীতি করার পর ধরা পরা ও শাস্তির ভয় ব্যতিরেকে দুর্নীতি করা সম্ভব হচ্ছে বলেই দুর্নীতি হচ্ছে এবং তা বন্ধ হচ্ছে না। 

রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের কেনাকাটার বিষয়ে দুর্নীতি বিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, এইটা একটা যোগসাজসের দুর্নীতি। এই সব দুর্নীতি যারা বন্ধ করার দায়িত্বে আছেন তাদের একাংশ এই দুর্নীতির টাকায় লাভবান হয়।  ফলে এই সকল দুর্নীতিবাজদের তারা সুরক্ষা দেয়। রেলের এই সকল দুর্নীতিবাজরা চিহ্নিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কোন নজির আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আসলে আমাদের দেশে ব্যবস্থা নেওয়া হয় চুনোপুটিদের বিরুদ্ধে। রুই কাতলাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

তিনি আরো বলেন, যে অর্থ অপচয় হয় এটা জনগণের অর্থ, তাই জনগণের এখতিয়ার এবং দায়িত্ব রয়েছে এবং এই সব অনিয়ম সম্পর্কে জানার অধিকারও রয়েছে।

সরকারি কেনা-কাটায় দুর্নীতি কিভাবে হয়?

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রপাতি ও পণ্যদ্রব্য কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি করাটা সহজ বলে প্রায়ই এ খাতে দুর্নীতির অভিযোগ আসে। তবে এখাতে দুর্নীতি ধরাটাও সহজ বিধায় এ খাতের দুর্নীতির খবর সামনে আসলেও অন্যান্য খাতের খবর বাকি থেকে যায় বলে মন্তব্য করেছেন সরকারি সাবেক আমলারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের সাবেক এক আমলা বলেন, "বহু ধরণের কাজের গ্রাউন্ড আছে যার দ্বারা কেনাকাটার সময় দুর্নীতি হয়ে থাকে। এটা নতুন নয়।" "বরং বহুদিন ধরে চলে আসছে এবং সময়ের সাথে এটি বেড়েই চলেছে।" কেনাকাটার ক্ষেত্রে দুর্নীতির এ খবর সরকার জানে বলেও মনে করেন তিনি।

আর এ কারণেই এ খাতে দুর্নীতি বন্ধে সরকার পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট এবং ই-টেন্ডারিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এ ধরণের ব্যবস্থা নিয়েও কোন লাভ হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন এই সাবেক আমলা।

তিনি আরো বলেন, "শত রকমের উপায় আছে কেনাকাটার ক্ষেত্রে দুর্নীতি করার। টেন্ডারিং প্রসেসের মধ্যে কাউকে টেন্ডার পাইয়ে দিতে চাইলে তাকে সব থেকে কম খরচের দেখানো, আগে থেকেই টেন্ডারের তথ্য ফাঁস করে দেয়া, দামের রেট বা হার বলে দেয়া, এগুলো তো আছেই। এছাড়া টেন্ডারের বৈশিষ্ট্য বা শর্ত এমনভাবে সাজানো হয় যাতে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তিই ওই সুযোগটি পায়। এধরণের আরো অনেক রকমের পদ্ধতি রয়েছে।

এই বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, 'পাবলিক মানি' বা সরকারি অর্থ নিয়ে এ ধরণের দুর্নীতি আসলে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়। কারণ এ অর্থ উন্নয়ন কিংবা জনগণের কাজে ব্যয় হওয়ার কথা থাকলেও দুর্নীতির কারণে তা ব্যক্তি পর্যায়ে কুক্ষিগত করা হয়।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, "এর ফলে পর্যাপ্ত অর্থ সংশ্লিষ্ট খাতে ব্যয় না হওয়ার কারণে হয় সেই উন্নয়ন কাজটি বাধাগ্রস্ত হয়, না হলে নিম্নমানের কাজ করা হয় অথবা যে কাজে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার কথা ছিলো তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় হয়"।

এ ধরণের দুর্নীতি দায়ভার যেভাবে জনগণের উপরে গিয়েই পড়ে:

প্রথমত কর হিসেবে জনগণ অর্থ দিয়ে দেয় বলে তাদের কাছে সেই নগদ অর্থ থাকে না। ফলে সে এই অর্থ নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারে না। আর দ্বিতীয়টি হলো, করের অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার হলে মানুষ যে সুযোগ-সুবিধা পেতো তা থেকেও বঞ্চিত হয় তারা। এই একই কারণে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হয় না বলেও মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।

 

 

 

 

** প্যাসেঞ্জার ভয়েস সব ধরনের আলোচনা-সমালোচনা সাদরে গ্রহণ ও উৎসাহিত করে। অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য পরিহার করুন। এটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। **