শিরোনাম
Yasin Hoque | ০১:১৪ পিএম, ২০২১-০২-০৪
ইয়াছিন হকঃ লন্ডনের বার্কলেস ব্যাংকের মুরগেট শাখায় ছেলে সাদমান জামানের একাউন্টে হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ পাচার। দেশীয় এজেন্ট বিশ্বাস বিল্ডারর্স থেকে কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ। জাল জালিয়াতির মাধ্যমে রেলে জনবল নিয়োগ। অবৈধ অর্থ দিয়ে রাজধানীর শান্তিবাগে দুই কোটি টাকা মূল্যের আড়াই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট, রাজধানীর পূর্বাঞ্চলে সাড়ে সাত কাঠার প্লট, মিরপুরে সাড়ে তিন কাঠা জায়গা ও যশোরের ঝিকরগাছায় ৬০ বিঘা জমিসহ দুই তলা বাড়ির মালিক বাংলাদেশ রেলওয়ের সদ্য সাবেক মহা পরিচালক ডিজি শামসুজ্জামান। সাবেক স্ত্রীকেও কিনে দিয়েছে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে রেলের ১০ লোকোমটিভ ক্রয়ে করেছে অনিয়ম দুর্নীতি এমন ডজন খানেক দুর্নীতির সুস্পষ্ট অভিযোগ ঘাড়ে নিয়ে অবশেষে বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে বিদায় হলেন মহাপরিচালক মোঃ শামসুজ্জামান।
সূত্র বলছে, ১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলায় জন্ম নেওয়া মোঃ শামছুজ্জামান ১৯৮৩ সালে বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে ১৯৮৫ সালে বিশেষ বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে বিভাগীয় কর্মকর্তা পদে যোগদান করেন বাংলাদেশ রেলওয়েতে। ছিলেন অতিরিক্ত প্রধান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, প্রধান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার রেলওয়ে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের সদর দপ্তরে ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) পদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি।
সাহিত্য লিখায় শামসুজ্জামানের ছিল ভালবাসা, লিখেছেন একাত্তরের মক্তিযুদ্ধসহ একাধিক গ্রন্থ। তবে রেলের এই শীর্ষ কর্মকর্তার অবসর জীবনটা কাটাতে হবে টেনশন আর ভীতির মধ্যে। রেল জীবনের প্রতিটি পদের হিসাববিহীন অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে বৃদ্ধদের কাতারে যাওয়া এই কর্তার অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
রেলের এই ডিজির বিরুদ্ধে যাত্রীবাহী কোচ কেনাকাটায় অনিয়ম, অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডার পাইয়ে দেওয়া, বিদেশে টাকা পাচার, অবৈধ টাকার পাহাড় তৈরি, জ্ঞাত আয় বহিভূর্ত সম্পদে বিলাসী জীবনসহ এক ডজনের অধিক অভিযোগ নিয়ে রেলের সচিবের কাছে তথ্য ও কাগজপত্র চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক।
এতদিন স্যার ডাকা রেল কর্তারা দুদকে অভিযোগ ঢেলে জটিল করছেঃ
এদিকে রেলওয়ের অনেক কর্মকর্তা মহাপরিচালক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুদকের চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ পাঠিয়েছে। অভিযোগে বলা হয় রেলে যাত্রী সেবা বাড়াতে ২০১৭ সালে ২০০ মিটারগেজ কোচ কেনায় অযোগ্য কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিতে দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করা হয়। যার ফলে কোচগুলো সরবরাহের কাজ পায় ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইনকা। শর্ত পরিবর্তন ও অনিয়মের কারণে কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন করেছেন এই মহাপরিচালক এমন তথ্য স্পষ্ট করে দুদকে জানিয়ে দিয়েছে কয়েকজন কর্মকর্তা।
দুর্নীতির অবৈধ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে লন্ডনে পাচার, জাল জালিয়াতি পূর্বক জনবল নিয়োগ, লোকাল এজেন্ট বিশ্বাস বিল্ডার্স লিমিটেডের নামে কোটি কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণের বিষয়েও অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।
শামসুজ্জামানের পুরো কর্মজীবনের দুর্নীতি ও লুটপাতের তথ্য চেয়েছে দুদকঃ
রেল সচিব বরাবর দেয়া দুদকের সর্বশেষ চিঠিতে ডিজি শামছুজ্জামানের অনিয়মের রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়েছে। এতে ১৯৯৬ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত রেলওয়ে উপ-পরিচালক থাকার সময়ে শামছুজ্জামানের বিরুদ্ধে এসিআর জালিয়াতির কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে সেই ঘটনার তথ্য-রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়। একই সঙ্গে ২০০৬ সালে রেলভবনে সিএমই/প্রজেক্টে থাকার সময়ে বরাদ্দের বাইরে ৮ কোটি টাকা খরচ করার যে অডিট আপত্তি হয়, তার তথ্য-রেকর্ড চেয়েছে দুদক। এছাড়া ২০১১ সালে রেলভবনে সিএমই/চট্টগ্রামের চেয়ারে থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল সেই কমিটির রিপোর্টসহ যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত দিতে বলা হয়। একই সঙ্গে সিএক্স/ কেলোকা/পার্বতীপুরে রিকুইজিশনের ভিত্তিতে শিরিজা মেটাল এবং বিশ্বাস বিল্ডার্স নামের দুটি কোম্পানির নামে রেল ইঞ্জিন মেরামত সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য-মেরামতকৃত মটর কতগুলো চালু-বিকল রয়েছে এবং মেরামতের পর কতদিন সচল ছিল এ সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য চেয়েছে দুর্নীতি বিরোধী এই সংস্থাটি।
এছাড়া গত ১০ বছরে শিরিজা মেটাল এবং বিশ্বাস বিল্ডার্স লিমিটেড রেলে সে সব মেরামতের কাজ করেছে তার আর্থিক মূল্য তালিকা চাওয়া হয়েছে। এছাড়াও ফেরদৌস ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ রেলওয়ের ২৭০০ এবং ২৬০০ গ্রুপের রেল ইঞ্জিনের জন্য কানাডা থেকে যেসব মটর সরবরাহ করা হয়েছে সেসবের যাবতীয় তথ্য, রেকর্ডপত্র এবং প্রতিষ্ঠানটি রেল এ পর্যন্ত কতগুলো প্রকল্পে কাজ করেছে কাজের আর্থিক মূল্য কত তারও তথ্যও চাওয়া হয়।
টেন্ডার প্রক্রিয়া প্রভাবিত করে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ঃ
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে ২০০ মিটারগেজ কোচ কেনার ক্ষেত্রে দরপত্রে শর্ত ছিল সরবরাহকারী কোম্পানিকে কমপক্ষে দেড় হাজার কোচ তৈরি ও সরবরাহের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইনকার সে যোগ্যতা না থাকায় পরে রেলওয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান নিজে তা পরিবর্তন করে ৫০০ কোচ তৈরি ও সরবরাহের অভিজ্ঞতার শর্ত দেন। যে কারণে কারিগরি যোগ্যতায় পিটি ইনকা টিকে যায়। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তা ম্যানেজ করে শামছুজ্জামান। পরবর্তীতে অতিরিক্ত মহাপরিচালক থেকে পদোন্নতি পেয়ে মহাপরিচালক হন তিনি। অযোগ্য কোম্পানিকে কাজ দেয়ায়-দেশীয় এজেন্ট বিশ্বার্স বিল্ডার্স থেকে কয়েক কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন তিনি এমন অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে।
লন্ডনে পাচার হয় রেলের টাকাঃ
শামছুজ্জামান অনিয়মের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ হুন্ডি হিসেবে লন্ডনে পাচার করেন বলে অভিযোগ করা হয়। তাঁর ছেলে সাদমান জামানের ব্যাংক হিসাবে এসব অর্থ জমা হয়েছে। ব্যাংক ও শাখার নামও উল্লেখ রয়েছে দুদকের নথিতে। সেটি হলো লন্ডনের বার্কলেস ব্যাংকের মুরগেট শাখা। শাখার ফোন নাম্বার ০৩৪৫৭৩৪৫৩৪৫ দেয়া হয়েছে। এসব অভিযোগে দেখা যায়, তিনি অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিংস্টক) থাকাকালে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ১০০ মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ কোচ ক্রয় করেন। এছাড়া ১১০টি ট্রাকশন মোটর মেরামতে অনিয়মের মাধ্যমে ২৪ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন।
এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে রেলের ১০ ইঞ্জিন ক্রয়েও ব্যাপক অনিয়ম করেছিল রেলের সদ্য সাবেক এই ডিজি। এসব ইঞ্জিনে দরপত্রের শর্তানুযায়ী যন্ত্রাংশ যুক্ত করা হয়নি, এগুলো তৈরি হয়েছে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে। চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ না করায় প্রকল্প পরিচালক তা গ্রহণ করেননি। পিডি নুর হোসেন নিজেই এসব ইঞ্জিন ক্রয়-গ্রহণে রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরীর বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন।
তবে রেল ভবনের একটি সূত্র বলছে অবসরের সময় ঘনিয়ে আশায় পুনরায় চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের জন্য বিভিন্ন জায়গায় তদবির করেছিলেন শামসুজ্জামান। সাম্প্রতিক সময়ে রেলের দক্ষ সচিব সেলিম রেজাকেও অবসরের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে দুর্নীতির বাহুবলে থাকা ডিজি শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে এমন গুরুত্বর এক ডজনের অধিক অভিযোগ থাকায় রেলের ভাবমূর্তি রক্ষায় পুনরায় তাকে আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে রেলওয়ের সাবেক ডিজি শামসুজ্জামানকে একাধিকবার কল করেও বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের নতুন মহাপরিচালকঃ
এদিকে এমন ডজন খানেক দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে শামসুজ্জামান অবসরে যাওয়ার পর গত ১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ রেলওয়ের নতুন মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার। একই সাথে ওই দিনে বিদায় নিয়েছেন সদ্য সাবেক এই ডিজি।
আরও পড়ুন >>> রেলের কেনাকাটায় হরিলুট: কব্জির জোরে বহাল দুর্নীতিবাজরা
আরও পড়ুন >>> রাজস্ব আত্মসাৎকারী দুর্নীতিবাজ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সিওএস বেলাল বরখাস্ত হচ্ছে
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2019 - 2024 PassengerVoice | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ
Developed By Muktodhara Technology Limited.