কেনাকাটায় হরিলুট

রাজস্ব আত্মসাৎকারী দুর্নীতিবাজ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সিওএস বেলাল বরখাস্ত হচ্ছে

Passenger Voice    |    ০৭:৪২ পিএম, ২০২০-১২-১২


রাজস্ব আত্মসাৎকারী দুর্নীতিবাজ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সিওএস বেলাল বরখাস্ত হচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ দেশের প্রজাতন্ত্রের সকল সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি বদলী ও পদায়ন এইটা একটি চলমান প্রক্রিয়া। সকল কর্মকর্তারা বদলীর সময় নিজের পরিবারের সদস্য ও প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ সব আসবাবপত্র সাথে নিয়ে যান । শুধু মাত্র বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিওএস) বেলাল হোসেন এর ব্যতিক্রম। তিনি সাথে নিয়ে যায় শুধু তার অবৈধ দুর্নীতির টাকা তোলার ক্যাশিয়ার উচ্চমান সহকারী নুরুল আমিন তালুকদারকে।  সিওএস বেলাল হোসেন সরকার সৈয়দপুর থেকে রাজশাহী, রাজশাহী থেকে চট্টগ্রাম যেখানে বদলী হয়েছেন বগল তলে করে নিয়ে গেছেন এই উচ্চমান সহকারীকে। 

২০১৮-১৯ অর্থবছরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভিন্ন স্টেশনের মালপত্র কেনাকাটায় এই সিওএস বেলাল সিন্ডিকেট চালিয়েছে হরিলুট। চলতি বছরের শুরুর দিকে পরিবহন অডিট অধিদপ্তর রেলওয়ের বিভিন্ন মাল কেনাকাটাসহ অন্যান্য বিষয়ে নিরীক্ষা করে। এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনের কপি প্যাসেঞ্জার ভয়েস ঘেঁটে ঘুঁটে জানতে পারে চাঞ্চল্যকর তথ্য। 

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকশীর বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা ডিসিওর চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন স্টেশনে লেভেলক্রসিং গেটে ব্যবহারের জন্য তালা, বালতি, ঝাণ্ডা ও বাঁশি কেনা হয়েছে। এইসব মালামাল উচ্চমূল্যে ক্রয় করে জনগণের রাজস্বের ২৬ লক্ষ ৭৩ হাজার ৮৫০ টাকার আর্থিক ক্ষতি করেছে রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তারা। এমনকি এই দুর্নীতির সাথে জড়িত রয়েছে,  এই ক্রয় সংক্রান্ত বাজার যাচাই কমিটি, এস্টিমেট/প্রাক্কলন প্রণয়নকারী, এস্টিমেট অনুমোদনকারী, টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি ও টেন্ডার মূল্যায়নের সুপারিশ অনুমোদনকারী এবং তাঁদের আস্তাভাজন ঠিকাদার। 

রেলের মালামাল ক্রয়ে দুর্নীতিতে জড়িত থাকায় চট্টগ্রামের সাবেক সিওপিএস এস এম শাহ নেওয়াজকে ওএসডি করলেও অদৃশ্য ক্ষমতার বলয় ব্যাবহার করে স্বপদে বহাল তবিয়তে ছিলেন পূর্বাঞ্চল রেলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিওএস) বেলাল হোসেন সরকার ও তার দুর্নীতির সাম্রাজ্যের অঘোষিত ক্যাশিয়ার উচ্চমান সহকারী নুরুল আমিন তালুকদার। 

কেনাকাটার অনিয়ম দুর্নীতি ও সরকারের রাজস্বের টাকা আত্বসাৎ এর ঘটনা তদন্তে চলতি বছরের ২০ সেপ্টেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. ভুবন চন্দ্র বিশ্বাসকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। উপসচিব মো. আবদুর রহিমকে সদস্য সচিব ও পাকশি রেলওয়ে বিভাগীয় ম্যানেজার মো. শাহীদুল ইসলামকে সদস্য করা হয়। কমিটি প্রায় ৩ মাস কাজ শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

সাম্প্রতিক রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের কাছে জমা দেয়া এই প্রতিবেদনে দুর্নীতিবাজ এই সিওএস বেলাল হোসেন সরকার ও উচ্চমান সহকারী ক্যাশিয়ার নুরুল আমিন তালুকদার, পশিম রেলের সাবেক চিফ কর্মাশিয়াল ম্যানেজার (সিসিএম) এএমএম শাহনেওয়াজ, সাবেক সহকারী সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (এসিওএস) মো. জাহিদ কাওছারে বরখাস্ত, বিভাগীয় ও ফৌজদারী মামলার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।

জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেলের জন্য বিভিন্ন মালামাল কেনায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। নিরিক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখিত আছে মালামালের বাজার যাচাই, এস্টিমেট/প্রাক্কলন প্রণয়নকারী, টেন্ডার আহব্বান ও পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করাসহ সকল কার্যক্রম সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক সিওএস বেলাল হোসেন সরকার এর দপ্তরে হয়। এছাড়া ক্রয় প্রক্রিয়ায় কর্তব্যে অবহেলা, অদক্ষতা এবং আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতিতে সরাসরি সহায়তাকারী হিসেবে আরও ১৩ কর্মকর্তার নাম এসেছে।

তবে ক্রয় কার্যক্রম চাহিদাপত্র দেওয়া পশ্চিমাঞ্চলের সাবেক সিসিএম মোঃ শাহ্ওয়াজ কে ওএসডি করা হলেও এখনও পর্যন্ত এই সিওএস বেলালের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া পশ্চিমাঞ্চলের রেলে অস্বাভাবিক দরে মালামাল ক্রয় করলেও বাজার যাচাই কমিটি, এস্টিমেট/প্রাক্কলন প্রণয়নকারী ও পণ্যের মূল্য নির্ধারণকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। 

এছাড়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় এই চক্রটি রেলওয়ে ঘুনটি ঘরে ব্যবহারের জন্য একটি তালা পাঁচ হাজার ৫৯০ টাকায়, প্রতিটি বালতি এক হাজার ৮৯০ টাকায়, প্রতি হুইসেল বাঁশি ৪১৫ টাকায় এবং হাত ঝাণ্ডা এক হাজার ৪৪০ টাকায় কিনেছেন। অথচ অডিট টিম বাজার ঝাচাই করে দেখতে পায়, একটি তালার বাজার মূল্য ১৫০ টাকা, বালতির বাজার মূল্য ৩০০ টাকা, একটি হুইসেল বাশিঁর বাজার মূল্য ৫০ টাকা এবং একটি হাত ঝান্ডার বাজার মূল্য ১৬০ টাকা। প্রতিটি পণ্যের উপর ৩০ % ভ্যাট, আইটি, সরবরাহকারী মুনাফা এবং আনুষঙ্গিক খরচ সহ প্রাক্কলিত মূল্য দাঁড়ায় তালা ১৬৫ টাকা, বালতি ৩৯০ টাকা, প্রতিটি বাঁশি ৬৫ টাকা, প্রতিটি হাত ঝান্ডা ২০৭ টাকা। উল্লেখিত মালামালের মধ্যে শুধু তালা বাজার মূল্যের ৩৩ গুন উচ্চমূল্যে ক্রয় করে সরকার তথা জনগণের রাজস্বের ১৮ লক্ষ ১৮ হাজার ৯০০ টাকা মেরে দিয়েছে চক্রটি। 

সরকারি মালামাল কেনাকাটার বিষয়ে জিএফআর বিধি-১১ এ বলা হয়েছে- প্রত্যেক বিভাগীয় প্রধান প্রতিটি ক্ষেত্রে আর্থিক শৃঙ্খলা এবং কঠোর মিতব্যয়িতা প্রতিষ্ঠার জন্য দায়ী। তিনি তাহার নিজের অফিস এবং তাঁহার অধস্তন ব্যয়ন কর্মকর্তাগণ যাহাতে আর্থিক বিধি-বিধান অনুসরণ করেন তার জন্য দায়ী। এ ক্ষেত্রে  আলোচ্য বিধিগুলো পরিপালন না করে অমিতব্যয়িতার সাথে সরকারি অর্থ খরচ করা হয়েছে।

রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের কেনাকাটার বিষয়ে দুর্নীতি বিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, এইটা একটা যোগসাজসের দুর্নীতি। এই সব দুর্নীতি যারা বন্ধ করার দায়িত্বে আছেন তাদের একাংশ এই দুর্নীতির টাকায় লাভবান হয়।  ফলে এই সকল দুর্নীতিবাজদের তারা সুরক্ষা দেয়। রেলের এই সকল দুর্নীতিবাজরা চিহ্নিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কোন নজির আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আসলে আমাদের দেশে ব্যবস্থা নেওয়া হয় চুনোপুটিদের বিরুদ্ধে। রুই কাতলাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

এদিকে রেলপথ সচিব মো. সেলিম রেজা সাংবাদিকদের বলছে,, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট  রেলপথমন্ত্রীর কাছে জমা দেয়া হয়েছে। সুপারিশ অনুযায়ী অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয়-ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি। 

পশ্চিমাঞ্চল রেলের সাবেক সিওএস- বর্তমানে পূর্বাঞ্চল রেলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক প্রকৌশলী মো. বেলাল হোসেন সরকারকে সরকারী ও ব্যক্তিগত মুঠোফোনে বারবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।

আরো পড়ুন>>>> রেলের কেনাকাটায় হরিলুট: কব্জির জোরে বহাল দুর্নীতিবাজরা

আরো পড়ুন>>>> রেলের মালামাল ক্রয়ে দুর্নীতিতে জড়িত চট্টগ্রামের সিওপিএস শাহনেওয়াজ