বিশৃঙ্খলার দায় কার

Passenger Voice    |    ১১:৩৫ এএম, ২০২১-০৫-০৯


বিশৃঙ্খলার দায় কার

জেলার অভ্যন্তরে গণপরিবহন চালুর সুযোগে গ্রামমুখো মানুষের ঢল নেমেছে। মহাসড়ক, ফেরিঘাটে করোনাকালের আগের ঈদগুলোর মতো উপচেপড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে কয়েক দিন ধরে। ঈদের আগে গাড়ি চালু হলে ভিড় হবে, তা আগেই অনুমেয় ছিল। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের তীব্র বিরোধিতার পরও জনস্বার্থে গণপরিবহন চালুর অনুমতি দিয়েছিল সরকার। এদিকে, ঘরমুখো মানুষের ভিড় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা থেকে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাটে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। তারা বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দেবে।

পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবিতে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিলেও তারাই এখন একে অবৈজ্ঞানিক বলছেন।
তাদের মতে, দূরপাল্লা ও আন্তঃজেলার বাস, লঞ্চ, ট্রেন বন্ধ থাকায় যাত্রীরা ভেঙে ভেঙে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, পিকআপ, ট্রাকে গাদাগাদি করে শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছেন। এতে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বেড়েছে। অর্ধেক আসন খালি রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দূরপাল্লার বাস চালু থাকলে যাত্রীরা সরাসরি গন্তব্যে পৌঁছাতে পারতেন। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি কমত

দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ রেখে প্রাইভেট গাড়ি চালুর রাখার নীতিরও আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন এসেছে, যাদের গাড়ি আছে শুধু তাদের জন্য কেন সুযোগ থাকবে। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় প্রাইভেট গাড়িতে যেতে পুলিশের মুভমেন্ট পাস নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। তবে বাস্তবে এ নিয়ম অকার্যকর; বরং প্রাইভেট গাড়িগুলো ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ সমকালকে বলেছেন, সবচেয়ে ভালো হতো, যদি পরিবহন একেবারেই বন্ধ রাখা যেত। যদি চালু করতে হয়, তাহলে পুরোপুরি চালু থাকা উচিত। এতে বরং বাসগুলোকে নিয়মকানুন মেনে যাত্রী পরিবহনে বাধ্য করা যাবে। সব বাস চালু থাকলে এত ভিড় ও গাদাগাদিও হতো না। বন্ধ ও খোলার মাঝামাঝি অবস্থায় ভালো কিছু হবে না।

গত ২ মে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা থেকে জেলার অভ্যন্তরে বাস চালুসহ ১৬ দফা সুপারিশ করা হয়। এ সুপারিশের ভিত্তিতে ৬ মে থেকে জেলার অভ্যন্তরে অর্ধেক আসন খালি রেখে গণপরিবহন চালুর অনুমতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা গণপরিবহন চালুর সুপারিশের তীব্র বিরোধিতা করলেও জনস্বার্থে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম। এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তার বক্তব্য জানা যায়নি।

সচিব নজরুল ইসলাম বলেছেন, দুই সপ্তাহ ধরে করোনা সংক্রমণ হার নিম্নমুখী। জীবনের সঙ্গে জীবিকার কথা চিন্তা করে সরকার অনুমতি দিয়েছে। তবে তা সাময়িক সময়ের জন্য। জেলার অভ্যন্তরে গণপরিবহন চালুর পর মহাসড়ক ও ঘাটে যাত্রীর ভিড়ের যে চিত্র এসেছে, তাতে কি মনে হয় না ওই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল? এ প্রশ্নে সচিব বলেছেন, শুধু সরকারকে দায় দিলে হবে না। মানুষকে সচেতন হতে হবে। এখন একটি যুদ্ধাবস্থা চলছে। যারা ঈদ করতে বাড়ি যেতে চাইছেন, তা তাদের বোঝা উচিত।

আধাআধি খোলা না রেখে দূরপাল্লার সব বাস চালু রাখলে গাদাগাদি ভিড় হতো না, সংক্রমণের ঝুঁকিও কমত- পরিবহন নেতাদের এ বক্তব্য প্রসঙ্গে সচিব বলেছেন, কী করলে কী হতো, এ আলোচনা অনর্থক। অর্ধেক আসন খালি রেখে দূরপাল্লা ও আন্তঃজেলা বাস চলাচলের অনুমতি দিলে মালিকরা কি তা মানত?,এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে অনুরোধ করেন, যে যেখানে আছেন, সেখানেই ঈদ উদযাপন করুন। বাংলাদেশেও ভারতের মতো অবস্থা যেন না হয়, সে জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা আহ্বান জানিয়েছে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার থেকে সড়ক ও রাস্তার চিত্র বলছে, অনুরোধ-আহ্বানে কেউ কান দিচ্ছেন না।

ডা. বে-নজির আহমেদ বলেছেন, শহরের মানুষের ঈদে গ্রামে যাওয়ার আবেগ রয়েছে। জেলার অভ্যন্তরে বাস চালুর অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে মূলত তাদের গ্রামে যাওয়ার উস্কানি দেওয়া হয়েছে। জেলার মধ্যে গণপরিবহন চললে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া যাওয়া সম্ভব।

সাধারণ বাস মালিকরাও একই কথা বলছেন। হিমাচল পরিবহনের মালিক আফতাব উদ্দিন মাসুদ বলেন, তার বাস ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া রুটের। মানিকগঞ্জ ভিন্ন জেলা হওয়ায় পুলিশ বাস চালু করতে দেয়নি। কিন্তু হাজার হাজার যাত্রী লোকাল বাসে ঢাকা থেকে নবীনগর যাচ্ছেন। সেখান থেকে অটোরিকশা, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, রিকশা, হেঁটে পাটুরিয়া ঘাটে যাচ্ছেন। নদী পার হয়ে যা পাচ্ছেন তা ধরে গন্তব্যে চলে যাচ্ছেন। পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা এক মাস কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করায় তারাও রোজগারের জন্য পথে নামতে বাধ্য হচ্ছেন।

ডা. বে-নজির আহমেদ বলেছেন, সরকার যদি কর্মহীন পরিবহন শ্রমিকদের নগদ ও খাদ্য সহায়তা দিত, তাহলে তাদের ঠেকানো যেত। করোনার জন্য সরকারের যে তহবিল রয়েছে, তা থেকে কয়েক লাখ শ্রমিককে এ সহায়তা দেওয়া কঠিন ছিল না।

সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান শনিবার সংবাদ সম্মেলনে দাবি জানিয়েছেন, শ্রমিকদের জন্য টার্মিনালে ১০ টাকা কেজির চালের ব্যবস্থা করতে হবে। সচিব নজরুল ইসলাম বলেছেন, দুই-আড়াই লাখ শ্রমিককে আড়াই হাজার টাকা করে সহায়তা দিয়েছে সরকার। সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেছেন, শ্রমিক ও যাত্রীরা দায়ী নয়। এক জেলার গাড়ি এবং যাত্রী যেন অন্য জেলায় না যায়, তা নজরদারির দায়িত্ব বিআরটিএ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।

সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেছেন, মানুষ সচেতন না হলে ভ্রাম্যমাণ আদালত, আইন দিয়ে জনস্রোত ঠেকানো যাবে না। প্রাইভেট গাড়ি নিয়ম ভেঙে ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেছেন, বাস বন্ধ রেখে প্রাইভেটকার চালু রাখলে গ্রামমুখো মানুষের স্রোত ঠেকানো যাবে না। গত বছরের ঈদেও তা সম্ভব হয়নি।

গতকাল সরেজমিনে গাবতলী ও আবদুল্লাহপুর এলাকায় সে চিত্রই দেখা গেছে। দুপুরে গাবতলী গিয়ে দেখা যায়, সেতুর পশ্চিম পাড় থেকে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে ছুটছেন যাত্রীরা। প্রাইভেটকারে চার থেকে পাঁচজন, মাইক্রোবাসে ১০ থেকে ১৬ জন যাত্রী তোলা হচ্ছে। মোটরসাইকেলও জনপ্রতি ৫০০ টাকা ভাড়ায় পাটুরিয়া ঘাটে যাত্রী নিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ড্রোন থেকে তোলা একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। যাতে দেখা যাচ্ছে, লকডাউনের মধ্যেও গাবতলী থেকে হেমায়েতপুর সড়কে যানবাহনের দীর্ঘ সারি।

গ্রামমুখো মানুষের ঢল থামাতে শুক্রবার মধ্যরাতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) সিদ্ধান্ত নেয়, দিনের বেলায় আর ফেরি চলবে না। শুধু রাতে পণ্যবাহী গাড়ি পারাপারে ফেরি থাকবে। কিন্তু শনিবার সকালেই যাত্রীর উপচেপড়া ভিড় তৈরি হয় শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া ঘাটে। মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি গাড়ি পারাপারের ফেরিতে শত শত যাত্রী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ওঠেন। যাত্রীর চাপের মুখে পাটুরিয়ায় ফেরি চালু রাখতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।

বিআইডব্লিউটিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম মিশা বলেছেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটে শুধু রাতে পণ্যবাহী পরিবহন পারাপারে ফেরি চালানোর সিদ্ধান্ত বহাল রয়েছে। দিনে ফেরি চলবে না।