টিআই আশিষের টোকেনে চট্টগ্রাম শহরে দাপাচ্ছে দেড় হাজার অবৈধ অটোরিকশা

Passenger Voice    |    ০৬:৩০ পিএম, ২০২১-০৩-১১


টিআই আশিষের টোকেনে চট্টগ্রাম শহরে দাপাচ্ছে দেড় হাজার অবৈধ অটোরিকশা

মঙ্গলবার সকাল ৯ টা ৫ মিনিট। নগরের কাপ্তাই রাস্তারমাথা পুলিশ চেকপোস্টে এসে দাঁড়ালো একটি সিএনজি অটোরিকশা (চট্টগ্রাম-থ : ১১-৪৩৩১)।গাড়ি থেকে নেমেই চালক আলম ট্রাফিক পুলিশের সদস্য প্রেয়স ও আজিজুরের সাথে খোশ গল্পে পেতে উঠলেন। ২৫ মিনিট পর দৃশ্যপটে হাজির সার্জেন্ট মাকসুদ। তাঁকে দেখেই ট্রাফিক সদস্য প্রেয়স ও আজিজুরের তৎপরতা বেড়ে গেলো। দশমিনিটের ব্যবধানেই চট্টগ্রাম জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত পাঁচটি সিএনজি অটোরিকশা আটক করলো এই দুইজন। এসময় ওই চালকদের কয়েকজনকে জরিমানা করেন সার্জেন্ট মাকসুদ। যদিও পাশে বসে তখনো খোশগল্প করেই যাচ্ছেন চট্টগ্রাম জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত টোকেন নেয়া সেই অটোরিকশা চালক আলম।

শুধু এই একজন আলমই নন। চট্টগ্রাম জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত সিএনজি অটোরিকশার প্রায় দেড় হাজার চালক ট্রাফিক পুলিশের এমন আতিথ্য পেয়ে থাকেন। যারা নির্দিষ্ট একটি টোকেনের মালিক বনেছেন নির্দিষ্ট মাসোহারা দিয়ে। আর চট্টগ্রাম নগরে চলাচল নিষিদ্ধ এসব অবৈধ অটোরিকশাকে বৈধতার টোকেন দেন চান্দগাঁও থানা এলাকার দায়িত্বে থাকা শহর ও যানবাহন পরিদর্শক (টিআই) আশিষ কুমার পাল।

অপরদিকে কোন বয়স্ক যাত্রী কিংবা রোগি নিয়ে টোকেন ছাড়া জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত সিএনজি কাপ্তাই রাস্তার মাথা ক্রস করে শহরের দিকে ঢুকলেই ট্রাফিক পুলিশদল চিলের মতো ঝাপটি ধরে মামলা কিংবা “টো” করে নিয়ে যায় তাদের।

শুধু তাই নয়, টোকেন বিহীন খালি অটোরিক্শা সিএনজি গ্যাসের জন্য সড়ক ক্রস করলেও মামলা কিংবা ‌টো এর শিকার হতে হচ্ছে প্রতিদিন। এভাবে চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনে কাপ্তাই সড়কে চলাচল করে এমন অন্তত ১০০ টি সিএনজি আটোরিক্শা মামলা এবং টো এর শিকার হয়েছে। টোকেন থাকলে সব জায়েজ এবং না থাকলে মামলা, মারধর কিংবা টো এর শিকার হওয়াকে অমানবিক বলেছেন ভুক্তভুগি ও প্রত্যক্ষদর্শীরা।

মঙ্গলবার এবং বুধবার সকালে প্রায় ২ ঘন্টা ওই পুলিশ চেকপোস্টে অবস্থান করে দেখা গেছে, কাপ্তাই রাস্তারমাথা ও কালুরঘাট এলাকা থেকে আগত (চট্টগ্রাম জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত) সিএনজি অটোরিকশা, ট্রাক ও মোটর চালিত রিকশাকে থামিয়ে একটি নির্দিষ্ট টোকেন যাচাই করছেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্য প্রেয়স ও আজিজুর। যেসব চালকের কাছে সিগারেটের প্যাকেটের উল্টোদিক বা সাদা কাগজে ‌‘টিআই আশিষ, নির্দিষ্ট একটি ফোন নম্বর ও স্থানীয় দালালের নাম’ লেখা টোকেনটি যাদের আছে তাদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। যাদের টোকেন নেই তাদের “টো” করা হচ্ছে কিংবা দেওয়া হচ্ছে মামলা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধুমাত্র এই একটি স্পটে নয়। টিআই আশিষ কুমার পালের এই রাজত্ব চলে নগরের চান্দগাঁও এলাকার ৮টি রুটে।

সেগুলো হলো- বহদ্দারহাট হক মার্কেট পয়েন্ট থেকে হাজীপাড়া, খতিবেরহাট, চট্টগ্রাম ইন্টার ন্যাশনাল হাসপাতাল, চাঁনমিয়া সড়ক, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, ১৪ নম্বর গ্যারেজ, মৌলভী পুকুর পাড়, সিএন্ডবি, বাহির সিগন্যাল, হামিদচর, দেশ গার্মেন্টস খাঁজা রোডের মুখ থেকে রাহাত্তারপুল, বলিরহাট।

আটটি রুটে টোকেনের বিনিময়ে চাঁদা আদায়ের জন্য রয়েছে চারজন দালাল। এরাই টিআই আশিষের প্রতিনিধি হিসেবে এই বিশাল এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন।

বাসটার্মিনাল এলাকা থেকে টোকেনের বিনিময়ে চাঁদা তোলেন জয়নাল, খাঁজা রোড থেকে চাঁদা তোলেন কাদের, সিএন্ডবি-বিসিক শিল্প এলাকা ও বহদ্দারহাট থেকে চাঁদা তোলেন জাহাঙ্গির ও বিপ্লব। এক্ষেত্রে তারা যোগাযোগের জন্য যেসব বিশেষ মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে সেসব তথ্যও এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে। চট্টগ্রাম জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত একটি অটোরিকশা মহানগরে চালানোর জন্য এসব দালালদের দিতে হয় ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। এই হিসাবে শুধুমাত্র অবৈধ অটোরিকশা খাতেই টিআই আশিষ কুমার পালের মাসিক আয় কমপক্ষে ১১ লাখ টাকা। এর বাইরে বহদ্দারহাট বাসটার্মিনাল থেকে বোয়ালখালী রুটে চলাচলকারী সাড়ে তিনশ টেম্পোকে মাসিক দেড় হাজার টাকা মাসোহারা দিতে হয়। এছাড়া ব্যাটারি চালিত মোটর রিকশা, প্রাইভেট সিএনজি, ট্রাক ও হিউম্যান হলার থেকে মাসে প্রায় ৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয় বলে তার বিরুদ্ধে ভুক্তভগিদের অভিযোগ।

মঙ্গলবার (৯ মার্চ) দুপুরে নগরের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার (এ ব্লক) মূল ফটকের কাছে কয়েকটি সিএনজি অটোরিকশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কাছে গিয়ে দেখতেই বোঝ যায় এসব চট্টগ্রাম জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত অটোরিকশা মহানগরে অবৈধভাবে যাত্রী পরিবহনের জন্য অপেক্ষা করছে।

এসময় জানতে চাইলে অটোরিকশা চালক মামুন বলেন, ‘টিআই আশিষ স্যারের টোকেনে গাড়ি চালাচ্ছি। শুধু আমি নয়, আমার মত হাজারের উপরে চালক এভাবে টাকা দিয়েই গ্রাম গাড়ি (জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত) শহরে চালাচ্ছে। এই টোকেন থাকলে শহরের কোথাও সমস্যায় পড়তে হয়না।’ এসময় টিআই কে জানতে চাইলে মামুন বলেন, ‘টিআই আশিষ স্যার। উনার দালালদের কাছ থেকে টোকেন নিলে শহরের ভেতর গাড়ি টালানো যায়। আমি প্রতি মাসে ১ হাজার ৫০ টাকা চাঁদা দেই।’

আরেক অটোরিকশা চালক জানে আলম জানান, পলাশ নামে একজন থেকে তিনি টোকেন নেন ১২’শ টাকায়। টিআই এর আওতায় গাড়ি চালাতে এ টাকা দিতে হয়, টোকেন থাকলে গাড়ি আর কেউ ধরে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চান্দগাঁও এলাকার যানবাহন পরিদর্শক (টিআই) আশিষ কুমার পাল দাবি করেন, ‘এসব নিউজ ভূয়া। ওরা ওরা চাঁদাবাজি করে আর টিআই আর ওসির নাম দেয়।’

এসময় তিনি স্ব-গর্বে বলেন, ‘আপনি কাপ্তাই রাস্তার মাথায় গিয়ে একটা নিউজ করেন, দেখবেন এরপর থেকে ওই এলাকায় খালি কাক উড়বে খালি কাক; হা .. হা ...হা ... । খাঁজা রোড- বহদ্দারহাট সবখানেই এই অবস্থা করা হবে। আমি নুতন আসছিতো ..দেখেন এবার পরিবর্তনের ছোঁয়া পাবেন।’

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, রেজিস্ট্রেশন, ট্যাক্স টোকেন ও ফিটনেসবিহীন অবৈধ রুট পারমিটের বিরুদ্ধে বিআরটিএ এবং ট্রাফিক পুলিশ মাঝে মাঝে লোক দেখানো অভিযান চালায়। তবে অভিযানের খবর আগেই পেয়ে যান অবৈধ অটোরিকশা চালকরা। যেসব সিএনজি চালক অবৈধ টোকেন নিতে বিলম্ব করেন বা নিতে অস্বীকার করেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা কিংবা রেকার লাগিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করা হয়। এসবের প্রতিবাদে গত ৮ মার্চ চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক মানবন্ধনের আয়োজন করে চট্টগ্রাম অটোরিকশা ও অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মোটরযান আইন অনুযায়ী বিআরটিএ’র নিবন্ধন ছাড়া কোন গাড়ি রাস্তায় চলাচলের সুযোগ না থাকলেও শুধুমাত্র শহর ও যানবাহন পরিদর্শক-টিআইদের টোকেনে চট্টগ্রাম শহরে অনায়াশে চলছে ‘চট্টগ্রাম’, ‘প্রাইভেট’ ও ‘নিলাম’ লেখা অনিবন্ধিত সিএনজি অটোরিকশা। এসব গাড়ি মহানগরীতে নিবন্ধিত গাড়ির মতো করেই সিকিউরিটি নেট (লোহার ঝাঁপ) লাগিয়ে সাধারণ যাত্রীদের সাথে প্রতারণা করে যাত্রী বহন করছে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের নম্বর প্লেট ছাড়াই শুধুমাত্র ‘নিলাম’ লেখা বোর্ড জুড়ে দিয়ে শহর দাপাচ্ছে কিছু অটোরিকশা। জানা যায়, বিভিন্ন মামলার আলামত হিসেবে জব্দকৃত সিএনজি অটোরিকশা অনেক সময় স্ক্র্যাপ হিসেবে নিলামে বিক্রি হয়। আদালত থেকে নিলামে এসব অটোরিকশা ক্রয় করে গাড়িতে ‘নিলামে ক্রয়কৃত’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে বিআরটিএ থেকে কোন প্রকার নিবন্ধন ব্যতিরেকে নগরে এসব চলাচলের সুযোগ করে দিচ্ছে ট্রাফিক কর্মকর্তাদের দালালরা।

সোমবার (৮ মার্চ) দুপুরে নগরের বহদ্দরহাট ফ্লাইওভারের নিচে খাঁজারোড এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কোনো ধরনের দ্বিধা ছাড়াই চট্টগ্রাম জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত, প্রাইভেট ও নিলামে কেনা লেখা অর্ধশত সিএনজি অটোরিকশা যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে। এসম কয়েকজন চালক টোকেন দিয়ে গাড়ি চালানো বিষয়টি এই প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন। অনেকে প্রতিবেদকের হাতে ক্যামেরা দেখে দ্রæত স্থান ত্যাগ করেন। বিকেলে একই চিত্র চোখে পরে নগরের সিএন্ডবি এলাকায়।

এসময় কথা হয় আবুল বশর নামে এক অটোরিকশা চালকের সাথে, যার গাড়িটি চট্টগ্রাম নগরের জন্য নিবনিন্ধিত নয়ই, চট্টগ্রাম জেলার জন্যও নিবন্ধিত নয়। বান্দরবান জেলায় নিবন্ধিত গাড়ির এ চালককে শহরে কিভাবে গাড়ি চালানা জানতে চাইলে তিনি কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়েই বলেন, ‘যেভাবে চালানো যায় সেভাবে চালাচ্ছি, এখানে টাকা দিলে সব হয়।’ আপনি কি এই গাড়ি নিয়ে শহরের সব যায়গায় যেতে পারেন ?- এমন প্রশ্নের জবাবে আবুল বশর বলেন, ‘হ্যাঁ .. টোকেন থাকলে সব জায়গায় যাওয়া যাবে। প্রতিমাসে নতুন টোকেন নিতে হয়।’

চট্টগ্রাম সড়ক পরিবহন শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরে বিশেষ টোকেনে চট্টগ্রাম নিবন্ধিত, নিলামে ক্রয় ও প্রাইভেট অটোরিকশাগুলো অবৈধভাবে যাত্রীবহন করছে। চট্টমেট্রো নিবন্ধিত অটোরিকশার মতো লোহার নেট লাগিয়ে যাত্রীদের সাথে গাড়িগুলো প্রতারণা করছে। এতে বৈধগাড়ির মালিক-শ্রমিকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তেমনি পুলিশের অবৈধ টোকেন বাণিজ্যের কারণে সরকার বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’

টিআই আশিষের এই টোকেন বাণিজ্য নিয়ে কথা বলেন সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর। তিনি বলেন, ‘আপনি হিসেব নিয়ে দেখেন আমরা কি পরিমান গ্রাম সিএনজি (জেলার রেজিস্ট্রেশনভুক্ত) ধরছি। এটা বলতে পারি আমাদের অবস্থান শক্ত, আমরা এগুলোকে কোনো পশ্রয় দিচ্ছিনা। স্পেসিক তথ্যে যদি কেউ ধরা পরে তাহলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। তবে আমরা এখন পর্যন্ত হাতেনাতে কাউকে পায়নি।’

এসময় এ প্রতিবেদক সিএমপি কমিশনারকে চান্দগাঁও থানা এলাকার দায়িত্বে থাকা শহর ও যানবাহন পরিদর্শক (টিআই) আশিষ কুমার পালের নেতৃত্বে টোকেনের বিনিময়ে অবৈধ সিএনজি অটোরিকশা চলার সুযোগ করে দেওয়ার বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরেন। পরে এসব তথ্য তাঁর স্টাফ অফিসার ও সহকারি পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলামকে সরবরাহ করতে অনুরোধ জানান।

সূত্র :  চট্টগ্রাম ২৪ ডট কম