ডুবতে যাওয়া ডেমু ট্রেন, ঘষামাজা করে পকেট ভরছে রেলের ঘুষখোর কর্মকর্তারা

Passenger Voice    |    ০১:০১ পিএম, ২০২১-০২-১১


ডুবতে যাওয়া ডেমু ট্রেন, ঘষামাজা করে পকেট ভরছে রেলের ঘুষখোর কর্মকর্তারা

ইয়াছিন হকঃ যাত্রীসেবার মান বাড়াতে এবং রেলকে আধুনিকায়ন করতে কেনা হয়েছিল ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ডেমু) ট্রেন। এতে মানও বাড়েনি, আধুনিকতার ছোঁয়াও লাগেনি। বরং ডেমু ট্রেন কেনা থেকে শুরু করে মেরামতের নামে কর্মকর্তাদের পকেট ভারি হয়েছে। এটি পরিচালনা করতে গিয়ে রেলের লোকসানের বোঝা বেড়েই চলেছে। ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা ডেমু ট্রেন নিয়ে শুরুতেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। যে কারণে কয়েক মাসের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায় ১০ সেট ট্রেন। এরপর বছরজুড়েই বিকল হতে থাকায় ডেমু ট্রেন মেরামতেও নানান জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ নিয়ে অভিযোগও জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। সম্প্রতি রেলওয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের সত্যতা ও দায়িত্বশীলতার প্রমান দিয়ে এসব বিষয়ে তথ্য-প্রমাণসহ দুদকে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন। প্যাসেঞ্জার ভয়েসের অনুসন্ধানে অভিযোগপত্র টি ঘেঁটে ঘুঁটে জানা যায় রেলের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

দুদকে জমা পড়া অভিযোগে বলা হয়, রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক, বিভাগীয় টেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার লোকোমোটিভ ডিএমই লোকো ঢাকা ও চট্টগ্রাম, ডব্লিউএম ডিজেল ঢাকা ও চট্টগ্রাম যৌথভাবে ব্যক্তিগত লাভের জন্য ইঞ্জিনপ্রতি ৫৫ লাখ টাকা করে ওভারহোলিং বিল পরিশোধ করেছেন। ডিজি শামছুজ্জামান নিজস্ব ক্ষমতার কৌশলে এই অর্ডার দেন। এভাবে ১৫ ডেমুতে ৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা ইঞ্জিন ওভারহোলিংয়ের নামে লোপাট করা হয়। এ দুর্নীতির টাকা মহাপরিচালক, বিভাগীয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, লোকোমোটিভ ডিএমই, লোকো ঢাকা, লোকো চট্টগ্রাম, ডব্লিউএম ডিজেল ঢাকা ও ডব্লিউএম ডিজেল চট্টগ্রাম ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।

অভিযোগে ডেমু ট্রেন মেরামতে তিন ধরনের জালিয়াতির তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ডেমুর ইঞ্জিন মেরামতে মূল কোম্পানিকে বাদ দিয়ে স্থানীয় এক কোম্পানিকে কাজ দেয়া হয়েছে। আবার ইঞ্জিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে অন্য কোম্পানি থেকে যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছে। এছাড়া ইঞ্জিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কারিগরি সহায়তা বা ম্যানুয়ালও নেয়া হয়নি।

রেল সুত্রে জানা যায়, ২০১১ সালে ৪২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ সেট ডেমু কেনার চুক্তি হয় চীনের তাংশান রেলওয়ে ভেহিকল কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে। এর সঙ্গে শুল্ক, কর, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, বিদেশ ভ্রমণ ও ভাতা সংযুক্ত করে সব মিলিয়ে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ৬৫৪ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে দেশে আসে ট্রেনগুলো। বছরে ১০০ কোটি টাকা মুনাফা হবে এ যুক্তিতে ট্রেনগুলো কেনা হলেও এখন রেলের লোকসানের বোঝাই ভারী করছে ডেমু। এছাড়া প্রতিনিয়ত বিকল হয়ে পড়ছে ডেমুগুলো।

ইঞ্জিন মেরামতে মূল কোম্পানিকে বাদ দিয়ে অনৈতিক সুবিধার বিনিময় স্থানীয় এক কোম্পানিকে কাজ দেয়াঃ 

দুদকে জমা দেয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ডেমুর ইঞ্জিন বিশেষ ধরনের। যেগুলোর মডেল নং-ডি২৮৭৬ এলইউই ৬২২। উচ্চগতিসম্পন্ন ভারী পরিবহনের জন্য খুবই আধুনিক ও উন্নতমানের ইঞ্জিন এগুলো। ইঞ্জিনগুলো তৈরি করেছে জার্মানির এমএএন গ্রুপ। এসব ইঞ্জিন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা, যা কখনও করা হয়নি। অথচ এমএএনের লোকাল অফিস বাংলাদেশেই আছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণ ও ওভারহোলিংয়ের জন্য ঢাকায় ওয়ার্কশপও স্থাপন করেছে কোম্পানিটি। বিদেশি প্রকৌশলী ও কারিগরীভাবে দক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে সেখানে কাজ করানো হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, রেলওয়ের পক্ষ থেকে কখনও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি।

অভিযোগে বলা হয়, ওয়ার্কশপ ম্যানেজার ডিজেল ঢাকার অধীনে ২০১৭-১৮ সালে ঢাকায় ১০টি ও ২০১৮-১৯ সালে চট্টগ্রামে ৫টি ডেমুর ইঞ্জিন ওভারহোলিং করা হয়েছে বলে দেখানো হয়, যা বাস্তবে ধোয়া-মোছা ছাড়া আর কিছুই নয়। রেলওয়ের ক্রয়নীতি অনুসারে ডেমু ইঞ্জিন ওভারহোলিং করতে হলে মূল কোম্পানি এমএএনের প্রতিনিধি থাকতে হবে বা এমএএনের মাধ্যমে করাতে হবে, যা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আমলে নেয়নি।

অভিযোগে সাবেক মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) এ কাজের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা নিয়মনীতি ভঙ্গ করে স্থানীয় এক কোম্পানিকে এই কাজ দেয়। অথচ তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কারিগরি বিশেষজ্ঞ নেই, নেই কোনো ওয়ার্কশপ। ওভারহোলিং করার কোনো যন্ত্রাংশও নেই। এছাড়া এমএএনের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখা গেছে, তাদের থেকে ওভারহোলিংয়ের জন্য কোনো খুচরা যন্ত্রাংশ কেনা হয়নি, কোনো কারিগরি সহায়তা নেয়া হয়নি, ইঞ্জিন ওভারহোলিংয়ের কোনো ম্যানুয়ালও নেয়া হয়নি।

এছাড়া তদন্তে জানা গেছে, ওভারহোলিং বলা হলেও বাস্তবে তেমন কোনো কাজ হয়নি।

"আস্থাভাজন" কোম্পানি থেকে যন্ত্রাংশ ক্রয়ঃ 

দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, ডেমুর জন্য বিভিন্ন খুচরা যন্ত্রাংশ সংগ্রহে মূল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাংশান ভেহিকলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। তবে ডেমুর খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহের জন্য ৩৮টি কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করেছে রেলওয়ে। আর এসব যন্ত্রাংশ কেনায় কোনো ধরনের উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে না। সীমিত দরপত্রের (এলটিএম) মাধ্যমে এসব কোম্পানি থেকেই ডেমুর যন্ত্রাংশ কেনা হবে। আবার ৩৮টি কোম্পানি বলা হলেও এগুলোর প্রকৃত স্বত্বাধিকারী ৫-৬জন ঠিকাদার। তারা নিজেদের কোম্পানির নামে ও বেনামে ব্যবসা করে যাচ্ছে। এগুলো হলো- এমআরআর ইন্টারন্যাশনাল, দ্য কসমোপলিটান করপোরেশন, এআরএম ইঞ্জিনিয়ার্স, জেআর এন্টারপ্রাইজ, এমআরটি ইন্টারন্যাশনাল ও ফেরদৌস ইমপেক্স (প্রা.) লিমিটেড। এই কোম্পানিগুলো নিজেদের মধ্যে কার্টেল করে নিয়েছে ও বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে বহুগুণ মূল্যে জিনিস বিক্রি করছে।

এদিকে ডেমুর মূল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাংশান ভেহিকলকে লিস্টেড না করায় বিভিন্ন যন্ত্রাংশের সঠিক দাম জানা যাচ্ছে না। তবে কেনা হচ্ছে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ। এক্ষেত্রে ডেমুর ট্র্যাকশন মোটর কেনার উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, ট্র্যাকশন মোটরের মূল ম্যানুফ্যাকচারার যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্রাইজেল সাপ্লাই ইনকরপোরেশন। কিন্তু যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী হিসেবে কানাডিয়ান ডিজেল ইমপেক্সকে রেল ইন্ডাস্ট্রিজ কানাডা ইনকরপোরেশনের ডিস্ট্রিবিউটর দেখানো হয়েছে। বাস্তবে রেল ইন্ডাস্ট্রিজ কানাডা ইনকরপোরেশনের সঙ্গে ডিজেল ইমপেক্সের কোনো সম্পর্ক নেই। আর এ কোম্পানি ট্র্যাকশন মোটর তৈরিও করে না।

ডিজেল ইমপেক্সের স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে এমআরআর ইন্টারন্যাশনালকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তবে বাস্তবে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিক একই। ফলে প্রকৃত ম্যানুফ্যাকচারার থেকে মালপত্র আনা সম্ভব হয়নি। এতে ট্র্যাকশন মোটর সম্পর্কিত ৪টি অর্ডার স¤প্রতি কমপ্লেইন পাওয়ার পরে রেল কর্তৃপক্ষ বাতিল করেছে। এর মধ্যে প্রথমটির অধীনে ১০টি, দ্বিতীয়টির অধীনে ১২টি, তৃতীয়টির অধীনে ১৪টি ও চতুর্থটির ১১টি ট্র্যাকশন মোটর কেনার কথা ছিল।

রেল কর্তৃপক্ষ অনুসন্ধান করে দেখেছে, এখানে বিরাট অনিয়ম হয়েছে। তাই এ দরপত্র বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু কাউকে এ বিষয়ে শোকজ করা হয়নি বা কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। অথচ এ চার অর্ডারের মাধ্যমে প্রায় ২৯ কোটি টাকা দুর্নীতির ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। ডেমুর ১০টি এইচএমআই ডিসপ্লে কেনায় অনিয়মের উদাহরণও তুলে ধরা হয়েছে অভিযোগে। এতে বলা হয়, এইচএমআইয়ের প্রতিটির দাম সর্বোচ্চ দুই হাজার ডলার হলেও ৪৯ হাজার ৮০০ ডলারে তা কেনা হয়েছে। এতে প্রায় চার কোটি টাকার দুর্নীতি করা হয়েছে। এছাড়া জাম্পার কেবল কেনা হয়েছে প্রতিটি চার হাজার ডলারে। যদিও এগুলোর দাম সর্বোচ্চ ২০০ ডলার।

এলটিএম পদ্ধতিতে বিভিন্ন লটে মাল ক্রয় করেছে সিসিএসঃ 

তৃতীয় অভিযোগটি হলো, ডেমুর খুচরা যন্ত্রাংশ একবারে সংগ্রহ না করে ছোট ছোট লটে কেনা হয়েছে। এক্ষেত্রে ২০১৭ সালের একটি দরপত্রের উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ডেমুর জন্য ১২৭ লাইন আইটেম কেনার কথা ছিল। তবে তা একেবারে না কিনে এলটিএমের মাধ্যমে ৫-৬টি ভাগে কেনা হয়, যাতে সিসিএস নিজেই তা অনুমোদন করতে পারে। কারণ দরপত্রের মূল্য বেশি হলে তা অনুমোদনের ক্ষমতা সিসিএসের নেই। সেক্ষেত্রে দরপত্র অনুমোদনের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠাতে হতো।

এসব অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো মন্তব্য করেননি।