জাহাজ থেকে তেল খালাস করতে বিলম্ব, মাশুল গুনতে হচ্ছে বিপিসিকে

Passenger Voice    |    ১২:৩২ পিএম, ২০২৫-১২-০৭


জাহাজ থেকে তেল খালাস করতে বিলম্ব, মাশুল গুনতে হচ্ছে বিপিসিকে

সিঙ্গাপুরের ইউনিপেক প্রাইভেট লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জন্য জ্বালানি তেল নিয়ে ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরে আসে ‘এমটি টর্ম’ নামে একটি ট্যাঙ্কার জাহাজ। চুক্তি অনুযায়ী, এ ধরনের জাহাজ থেকে ১২০ ঘণ্টার মধ্যে তেল খালাস করার কথা বিপিসির। কিন্তু তেল খালাসে বাড়তি সময় লেগে যায় ১৪২ ঘণ্টা। এ জন্য বিপিসিকে বিলম্ব মাশুল গুনতে হয় চার লাখ ১৪ হাজার ৭৫০ ডলার। প্রতি ডলার ১২২ টাকা ১০ পয়সা হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় এ ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ কোটি ছয় লাখ ৪০ হাজার ৯৭৫ টাকা। 

ওই বছরেরই ২৮ অক্টোবর তেল নিয়ে এসেছিল পিটি বুমি সিয়াক যাপিন ইন্দোনেশিয়ার এমটি এনার্জি অ্যাসিলেস নামে একটি জাহাজ। সেখান থেকেও চুক্তির নিয়ম ভেঙে তেল খালাসে বাড়তি ১৫১ ঘণ্টা লাগে। এতে বিপিসিকে বিলম্ব মাশুল দিতে হয় তিন লাখ ৩২ হাজার ২৮১ ডলার বা চার কোটি সাত লাখ ৩৭ হাজার টাকার বেশি। 

একইভাবে কুয়েত পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (কেপিসি) থেকে তেল নিয়ে ৮ এপ্রিল ২০১৭ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিল ‘এমটি জঙ্গিজি নম্বর-১’। জাহাজটি থেকে ১০৮ ঘণ্টার মধ্যে তেল খালাসের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথচ তেল খালাসে অতিরিক্ত সময় লেগে যায় ১১১ দশমিক ০৬ ঘণ্টা। এ জন্য বিপিসিকে বিলম্ব মাশুল দিতে হয় ৮১ হাজার ১০ দশমিক ৪২ ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৯৮ লাখ ৮৮ হাজার ৮৭ টাকা। 

এভাবে প্রায়ই চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জাহাজ থেকে তেল খালাস করতে না পারায় বিলম্ব মাশুল গুনতে হচ্ছে বিপিসিকে। ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিপিসি নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ বিভাগের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিভিন্ন আকৃতির ৪৫টি জাহাজ থেকে তেল খালাসে বিলম্বের জন্য মাশুলই গুনতে হয়েছে মোট ৩৮ লাখ ৭০ হাজার ৭৪৩ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ৪৭ কোটি ২৪ লাখ ৯৮ হাজার ৪৮৯ টাকা। অর্থাৎ, একেকটি জাহাজ থেকে তেল খালাসে বাড়তি সময় লেগেছে সর্বনিম্ন তিন ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ ২৯৩ ঘণ্টা পর্যন্ত। 

বিপিসি সূত্র জানায়, বিশেষ করে ইউনিপেক সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড, কেপিসি, পিটি বুমি সিয়াক যাপিন ইন্দোনেশিয়া, এমিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (সিঙ্গাপুর) প্রাইভেট লিমিটেড এবং ভিটল এশিয়া প্রাইভেট লিমিটেড সিঙ্গাপুর বাংলাদেশকে আমদানির বেশির ভাগ তেল সরবরাহ করে। মাদার অয়েল ট্যাঙ্কার বা বড় ট্যাঙ্কার জাহাজে তেল নিয়ে আসা হয়।

চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে এসব জাহাজ নোঙর করার পর সেখান থেকে লাইটারেজ বা ছোট জাহাজে করে এসব তেল নিয়ে যাওয়া হয় বিপিসির বিপণন প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড, যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টোরেজ টার্মিনালে। ফলে জাহাজ থেকে শুধু তেল খালাসে বিলম্বই নয়, এভাবে তেল খালাস ও পরিবহনের ফলেও বিপুল অঙ্কের তেল অপচয় ও চুরি হয়।

বিপিসি কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো একটি জাহাজ আসার অন্তত এক মাস আগে থেকে সেটির তেল খালাসের পরিকল্পনা করা হয়। এ জন্য শিডিউল অনুযায়ী ভাড়া করে রাখা হয় লাইটারেজ। কোন তেল কোথায় যাবে এবং কত পরিমাণে যাবে, এটাও ঠিক করা থাকে। এর পরও অদক্ষতার কারণে পরিকল্পনামতো নির্ধারিত সময়ে মধ্যে তেল খালাস করা যায় না। জ্বালানি ও খনিজ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তেল খালাস করতে না পারলে চুক্তি লঙ্ঘন হয়। এ কারণে ডেমারেজ, অর্থাৎ বিলম্ব মাশুল গুনতে হয় বিপিসিকে। তেল খালাসে দক্ষতা বাড়ানো গেলে অর্থ অপচয় কমে আসবে।

তবে বিষয়টি তেল আমদানি-রপ্তানির অংশ বলে মনে করেন বিপিসির ঊর্ধ্বতন মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন্স) মনি লাল দাশ। তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো সময় দুটি জাহাজ নোঙর করে। একটি জাহাজ থেকে তেল খালাস করতে গিয়ে অপর জাহাজ থেকে তেল খালাসে বাড়তি সময় লেগে যায়। কখনও কখনও প্রাকৃতিক কারণ, যেমন– সাগর অতিমাত্রায় উত্তাল থাকলে এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক লাইটারেজ পাওয়ার বিষয়টি তো রয়েছেই।’

জানা গেছে, লাইটারেজে করে তেল খালাসের কারণে বিপুল ব্যয়, অপচয় ও চুরি ঠেকাতে জাহাজ থেকে পাইপলাইনে তেল খালাসে বাস্তবায়ন করা হয় ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম)’ প্রকল্প। কিন্তু আট হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটির পাইপলাইনে ত্রুটি ও পরিচালনায় অপারেটর নিয়োগ করতে না পারায় এটি দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে অলস পড়ে রয়েছে।

প্রকল্পটির আওতায় সাগরে ভাসমান জেটির সঙ্গে ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ১১০ কিলোমিটার দীর্ঘ অফশোর ও অনশোর পাইপলাইন যুক্ত। জাহাজ থেকে সরাসরি ডিপোতে তরল জ্বালানি পৌঁছাতে এই পাইপলাইন বসানো হয়েছে। বিপিসির সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) জন্য এটি তৈরি করা হয়। এর কমিশনিং হয় ২০২৪ সালের মার্চ মাসে। কিন্তু পাইপলাইনে ত্রুটি ও পরিচালনায় অপারেটর নিয়োগ না দেওয়ায় এটি কাজে আসছে না। পাইপলাইনে তেল খালাস করা গেলে ১১ থেকে ১২ দিনের কাজ মাত্র দুই দিনে শেষ করা যেত। এতে তেলের অপচয় কমত এবং বছরে সাশ্রয় হতো প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ইআরএলের এক কর্মকর্তা জানান, মাদার ভেসেল থেকে তেল আনার পাইপলাইন ফুটো হয়ে গেছে। এ ছাড়া জাহাজ থেকে তেল বের করার পয়েন্টেও ত্রুটি রয়েছে। গোটা প্রকল্প যারা তৈরি করেছে, তারা এই পাইপলাইন সারানোর বিষয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া পাইপলাইন পরিচালনায় অপারেটর নিয়োগে টেন্ডার আহ্বান করে আমরা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।