রেলওয়েতে অনুদানের টাকায় প্রমোদ ভ্রমণ!

Passenger Voice    |    ০২:২১ পিএম, ২০২৫-১১-২৭


রেলওয়েতে অনুদানের টাকায় প্রমোদ ভ্রমণ!

বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ পাওয়া গেছে বাংলাদেশ রেলওয়ের কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। কারিগরি পর্যায়ের ওই প্রশিক্ষণে যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের উপযুক্ত কর্মকর্তাদের না নিয়ে উল্টো সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় রেল মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিবসহ অপর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। রেলসংশ্লিষ্ট অনেকেই দক্ষিণ কোরিয়ায় এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যাওয়াকে ‘আনন্দ ভ্রমণ’ বলে অভিহিত করেছেন। অনুদানের টাকায় ওই কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। 

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনের চেয়ে ব্যক্তিগত পছন্দের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশে ভ্রমণের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে ওই প্রশিক্ষণের ব্যানারে।

সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, কেবল এখানেই শেষ নয়, যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের একই ধরনের আসন্ন অপর একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে আরেকটি অনিয়ম ঘটানোর অপচেষ্টা চলছে। সনদধারী উপযুক্ত (ডিপ্লোমা প্রকৌশলী) কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে লোকোমোটিভ শেডের কর্মচারীদের (ইলেকট্রিশিয়ান) বিদেশে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প পরিচালকের পছন্দ-অপছন্দ আর ব্যক্তিগত সিন্ডিকেট বজায় রাখতে তিনি এমন অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করেছেন বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প) ও প্রকল্প পরিচালক ফকির মো. মহিউদ্দীন প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে এ বিষয়ে তার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন মহাপরিচালকের কাছে।

ওই প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়াতে তিন সপ্তাহের এই প্রশিক্ষণের জন্য রেলওয়ের লোকোমোটিভ শেড ও কেলোকা ওয়ার্কশপের ছয়জন কর্মচারীর নাম প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত করে পাঠানো হয়েছে। গত ২৪ নভেম্বর থেকে আগামী ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয় ওই চিঠিতে। তবে এখনো অনুমোদন না হওয়ায় এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি কয়েক দিন পিছিয়ে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

রেলওয়ের যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের রোলিং স্টক (লোকোমোটিভ) ব্যবস্থাপনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় মোট ১০ জনের বিদেশে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে দক্ষিণ কোরীয় সরকারের অনুদানে। প্রস্তাবে ছয়জন ডিপ্লোমা প্রকৌশলীকে যুক্ত করার কথা থাকলেও সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ইলেকট্রিশিয়ান পদের ছয় কর্মচারীকে। বাকি চারজনের মধ্যে তিনজন প্রকৌশলী এবং একজন রেলওয়ের উপপরিচালক রয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত কর্মচারীরা (ইলেকট্রিশিয়ান) রেলওয়ের যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলেও প্রকৌশলীদের পরিবর্তে তাদের পাঠিয়ে সরকার বা এই সংস্থার প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জিত হবে না। পাশাপাশি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের সময় মূল সমস্যা হবে কোরিয়ান বা ইংরেজি ভাষার সমস্যা। ভাষাগত সমস্যা হলে প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু আয়ত্ত করতে যেমন কর্মচারীদের সমস্যা হবে, তেমনিই প্রশিক্ষণের সাফল্য আসবে না। এতে কোরিয়া সরকারের অনুদানের এই অর্থ যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ব্যয় হচ্ছে তার প্রকৃত মূল্যায়ন হবে না বলেও মন্তব্য করেন অনেকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেল সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু এ প্রসঙ্গটি আমাকে জানিয়েছেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’ প্রশিক্ষণের সময় ভাষাগত সমস্যার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এই কারণে এই তালিকায় প্রশিক্ষণের জন্য আরও দুজন কর্মকর্তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, সেটা বিবেচনা করছে মন্ত্রণালয়।

এর আগে গত ১১ থেকে ১৮ নভেম্বর সময়ে একই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকসহ অন্য পাঁচজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রোলিং স্টক ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ে ‘কথিত প্রশিক্ষণ’ শেষ করে ফিরে এসেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত এই প্রশিক্ষণে যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত না করে রেলওয়ের অপারেশন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে যুক্ত করায় এটিকে আনন্দ ভ্রমণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। 

তাদের মধ্যে রেলের রোলিং স্টক ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রশিক্ষণের এই কর্মসূচিতে রেলওয়ের অপারেশন বিভাগের যুগ্ম মহাপরিচালক (জেডিজি) মো. শহিদুল ইসলাম ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-৪ শাখার উপসচিব মো. নাজমুল হুদাকে প্রশিক্ষণের জন্য কোরিয়া নিয়ে যান প্রকল্প পরিচালক। অথচ জেডিজি শহিদুল ইসলামের যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের (রোলিং স্টক) কার্যক্রমের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই। আবার মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার উপসচিবেরও এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। এতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় এবং যে উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ হয়েছে, সেটিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। 

প্রশিক্ষণে গিয়ে কী বুঝলেন, কী জানলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে উপসচিব নাজমুল হুদা  বলেন, ‘আমি তো টেকনিক্যাল পারসন নই। এটা আসলে টেকনিক্যাল বিষয় তাই…।’ এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে তিনি প্রাসঙ্গিক কি না জানতে চাইলে এই উপসচিব কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। 

অন্যদিকে প্রশিক্ষণের অর্জন সম্পর্কে জানতে জেডিজি শহিদুল ইসলামকে (অপারেশন) একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

এ বিষয়ে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) আহমেদ মাহবুব চৌধুরী বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমাকে কোনো কিছু জানানো হয়নি। আমি প্রশিক্ষণসংক্রান্ত এসব প্রস্তাব পাঠানো বা কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচনের বিষয়েও কিছু জানি না। অথচ সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী বিভাগীয় প্রধান হিসেবে প্রশিক্ষণ কর্মসূচিকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নির্বাচন আমার করে দেওয়ার কথা।’

রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন অপর এক কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ নিয়মে রেলের কোনো বিভাগের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে দেশে বা বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত করে থাকেন সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা শাখার শীর্ষ কর্মকর্তা। 

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক ফকির মো. মহিউদ্দীনকে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন সংযোগ কেটে দেন। কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। 


প্যা.ভ.ম