পানিতে ডুবে মৃত্যুর মিছিল

Passenger Voice    |    ০৩:২৬ পিএম, ২০২৫-১১-০৩


পানিতে ডুবে মৃত্যুর মিছিল

জামালপুর জেলায় গত পাঁচ বছরে পানিতে ডুবে প্রাণ গেছে ১২৯ জনের। তাদের মধ্যে শিশু-কিশোরের সংখ্যাই বেশি। জেলা পুলিশের অপরাধ তদন্ত শাখা, জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তর, বেসরকারি সংস্থা শিশু কল্যাণ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্কের তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

জানা গেছে, জামালপুর সদরসহ সাত উপজেলায় পাঁচ বছরে পানিতে ডুবে মারা গেছে অনেক শিশু, কিশোর ও নারী-পুরুষ। প্রতিবছরই নদী, খাল, পুকুর, বিল কিংবা বন্যার পানিতে ডুবে এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এসব অকাল মৃত্যু রোধে সরকারিভাবে কোনো কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

স্থানীয় প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, জেলার প্রতিটি উপজেলাতেই প্রায় প্রতি মাসে একাধিক মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। বিশেষ করে বন্যা মৌসুমে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যায়। এসব মৃত্যু শুধু সংখ্যা নয়; বরং প্রতিটি প্রাণের পেছনে রয়েছে একেকটি পরিবার ও একেকটি অসম্পূর্ণ স্বপ্ন।

স্থানীয়রা জানান, জামালপুরে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা নতুন কিছু নয়। গত পাঁচ বছরে জেলার অন্তত শতাধিক স্থানে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে মাদারগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ ও ইসলামপুর উপজেলায়।

২০২৪ সালে সদর উপজেলার একটি পুকুরে একই পরিবারের দুই শিশুর মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালে বকশীগঞ্জে স্কুল ছুটির পর নদীতে নামলে তিন বন্ধুর মধ্যে দুজন আর ফিরে আসেনি। গত শুক্রবারে মাদারগঞ্জে ঝিনাই নদীতে গোসল করতে গিয়ে একসঙ্গে পাঁচ শিশু নিখোঁজ হয়। তিন দিন উদ্ধার অভিযানে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। গত বছর বন্যার পানি দেখতে গিয়ে মেলান্দহ উপজেলার চার শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়।

ভুক্তভোগীদের স্বজন জানান, প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেলেও কেন এসব দুর্ঘটনা ঘটছে, কীভাবে রোধ করা যায়, সে ব্যাপারে সরকারি কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। যে কারণে পানিতে ডুবে প্রতিবছর মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জামালপুরে পানিতে ডুবে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো শিশু-কিশোরদের প্রতি অভিভাবকদের নজরদারির অভাব, সাঁতার না জানা, পরিত্যক্ত গর্তে পানি জমে থাকা, অবৈধ ড্রেজারের সৃষ্ট গর্ত, বন্যার সময় বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানির উৎস ও প্রাথমিক উদ্ধার জ্ঞানের অভাব।

স্থানীয়রা বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই জামালপুর জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাই, দশআনি ও জিঞ্জিরামসহ অসংখ্য নদ-নদী। এর সঙ্গে রয়েছে খাল, বিল ও বন্যার সময় সৃষ্টি হওয়া জলাবদ্ধতা। এ ছাড়া জেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই একাধিক পুকুর-জলাশয় রয়েছে। যেখানে শিশু-কিশোরদের অবাধ যাতায়াত থাকে। অভিভাবকরা কৃষিকাজ, বাজার বা ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকেন। শিশুরা খেলতে খেলতে পুকুরের ধারে চলে যায়। অনেক সময় হাঁটুসমান পানিতেই ঘটে যায় মৃত্যুর ঘটনা। তাদের অভিযোগ, প্রতিবছরই জেলার বিভিন্ন এলাকায় পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। প্রশাসন আসে, খবর নেয়, কিন্তু এরপর আর কিছু হয় না। লাশ দাফন-কাফনের জন্য কিছু আর্থিক সহায়তা দিয়েই দায় এড়ান তারা।

নদীপারের বাসিন্দারা জানান, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি বাড়ে, রাস্তা, বাড়িঘর ও আঙিনা তলিয়ে যায়। সে সময়ই শিশু-কিশোররা গোসল বা সাঁতারের জন্য পানিতে নামে। সামান্য অসতর্কতা বা প্রবল স্রোতে হারিয়ে যায় তাদের জীবন।

স্কুল শিক্ষক আব্দুল জলীল বলেন, জামালপুরে স্কুলপড়ুয়া শিশু-কিশোরদের মধ্যে সাঁতার শেখার প্রবণতা খুব কম। প্রতিবছর জিলা স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী পুকুরে ডুবে মারা যাচ্ছে। তাঁর ভাষ্য, পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে বাড়ির পাশে পুকুর থাকলে বেড়া দেওয়া, শিশুদের একা বাইরে খেলতে যেতে না দেওয়া এবং সাঁতার শেখার সুযোগ করে দেওয়া সবচেয়ে কার্যকর।

জামালপুর জেলা শিশু কল্যাণ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্কের সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিমের ভাষ্য, তাঁর সংস্থার জরিপে উঠে এসেছে গত পাঁচ বছরে জেলায় পানিতে ডুবে ১২৯ জনের মৃত্যুর পরিসংখ্যান। পারিবারিক অসচেতনতা, সরকারিভাবে সাঁতার শেখার ব্যবস্থা না থাকা, নদী-নালা থেকে অবৈধ ডেজারে অপরিকল্পিত খনন করে মৃত্যুকূপ তৈরি করার কারণেই পানিতে ডুবে অকাল মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, তাঁর সংস্থার উদ্যোগে তিন মাস ধরে জেলার শিশু-কিশোরদের বিনামূল্যে সাঁতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রথম ব্যাচের ৮০ জনের প্রশিক্ষণ চলছে। দ্বিতীয় ব্যাচের জন্য শিশু-কিশোর নির্বাচন করা হচ্ছে।

জেলা পুলিশের অপরাধ তদন্ত শাখার পরিদর্শক কামরুজ্জামান তালুকদার জানান, গত দুই বছরে জেলার সাতটি থানায় পানিতে ডুবে ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি ঘটনার পরই থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, রেকর্ড অনুযায়ী মৃতদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু। অনেকেই খেলার ছলে বা গোসল করতে গিয়ে পানিতে পড়ে গেছে। কিছু ঘটনা ঘটেছে বর্ষাকালে বাড়ির পাশের ডোবা বা জমে থাকা পানিতে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে জেলা সদরসহ সাত উপজেলা থেকে শতাধিক মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। যারা সহায়তা চেয়েছেন, তাদের পরিবারকে লাশ দাফনের জন্য ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সুপার সৈয়দ রফিকুল ইসলাম বলেন, জামালপুরে অনেক নদ-নদী ও খাল-বিল। বন্যার সময় শিশু-কিশোরদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। যে কারণে এই জেলায় পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার বেশি। ওই সময় পুলিশের মাধ্যমে সচেতনতার কাজ করা হয়। তাঁর ভাষ্য, সাঁতার শেখানো, অবৈধ ড্রেজার নিয়ন্ত্রণ এবং পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা গেলে এসব দুর্ঘটনা অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

 

 

প্যা.ভ.ম