খুলনা-মোংলা রেলপথ: থেমে আছে অর্থনৈতিক অগ্রগতি

Passenger Voice    |    ০৪:৪৭ পিএম, ২০২৫-১১-০২


খুলনা-মোংলা রেলপথ: থেমে আছে অর্থনৈতিক অগ্রগতি

অনেক বড় আশা নিয়ে খুলনা-মোংলা রেলপথটি তৈরি করা হয়েছিল। এতে মোংলা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ স্থাপিত হলেও এখনও বন্দর থেকে শুরু হয়নি পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল। চার হাজার ২৬১ কোটি টাকায় নির্মিত এই রেলপথে এখন চলে মাত্র একটি কমিউটার ট্রেন। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত এবং মোংলা বন্দর ব্যবহার করে কম খরচে পণ্য আমদানি-রফতানির উদ্দেশ্যে এটি করা হলেও দেড় বছরেও পণ্যবাহী ট্রেন চালু করা যায়নি। ফলে থেমে আছে অর্থনৈতিক অগ্রগতি।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর চালু হওয়া খুলনা-মোংলা রেলপথের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলার মাধ্যমে আমদানি-রফতানি পণ্য দ্রুত ও সাশ্রয়ীভাবে পরিবহন করা। তবে বাস্তবে দেড় বছরের ব্যবধানে সেই লক্ষ্য এখনও অধরা থেকে গেছে। নবনির্মিত রেলপথে বর্তমানে মাত্র একটি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে; নিয়মিত কোনও পণ্যবাহী ট্রেন নেই। ফলে চার হাজার ২৬১ কোটি টাকার প্রকল্পটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হতে পারছে না। এর মধ্যে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে রেল সংযোগ সংক্রান্ত প্রকল্পে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি রুপির অর্থায়ন ও নির্মাণকাজ সাময়িক স্থগিত করেছিল ভারত। এসব প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম খুলনা-মোংলা রেলপথ। এ অবস্থায় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়লো মোংলা বন্দর থেকে ট্রেনে পণ্য পরিবহন। 

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ গত পাঁচ মাসে বিভিন্ন সময়ে এই পথে ১৫টি পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করেছে। এতে দেড় কোটি টাকা আয় হয়। যা গত দেড় বছরে যাত্রীবাহী ট্রেন থেকে আয়ের তিন গুণ। অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পনার ঘাটতি ও সমন্বয়ের অভাবে এই রেলপথের সম্ভাবনা থেমে আছে। রেলওয়ে, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিলে এই রেললাইন শুধু বন্দরকেন্দ্রিক অর্থনীতি নয়, পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের এক নতুন অধ্যায় রচনা করতে পারবে।

খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রানজিট সুবিধার আওতায় ভারত, নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন সহজ করতে ২০১০ সালে খুলনার ফুলতলা রেলস্টেশন থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। প্রকল্পটি তিন বছরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এরপর পেরিয়ে যায় আরও ১০ বছর। মেয়াদ বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে প্রকল্পের ব্যয়ও। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় এক হাজার ৭২১ কোটি টাকা থাকলেও কয়েক দফায় মেয়াদ বেড়ে বর্তমানে ব্যয় দাঁড়ায় চার হাজার ২৬১ কোটি টাকা। ভারত সরকারের ঋণসহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লার্সেন অ্যান্ড টার্বো ও ইরকন ইন্টারন্যাশনাল। ভারত সরকার প্রকল্পে ব্যয় করেছিল তিন হাজার ৩০০ কোটি রুপি। প্রকল্পের ৯১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ ছাড়াও খুলনার রূপসা সেতুর ওপর পাঁচ দশমিক ১৩ কিলোমিটার একটি রেলসেতু করা হয়। পাশাপাশি প্রকল্পের আওতায় ১০৭টি ছোট ব্রিজ, ৯টি আন্ডারপাস, ১১টি স্টেশন নির্মাণ করা হয়।

তখন এই পথের মাধ্যমে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলার কার্যকরিতা বাড়ানোর কথা ছিল। একইসঙ্গে বন্দরের একটি টার্মিনাল পরিচালনারও সুযোগ পায় দেশটি। এজন্য ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি এই রেলপথ উদ্বোধন করেন। এর সাত মাস পর ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০২৪ সালের ১ জুন একটি যাত্রীবাহী ট্রেন চালু করা হয়। সেটি খুলনা-বেনাপোল রেলপথে একবার, বেনাপোল থেকে মোংলা রুটে একবার ও মোংলা থেকে বেনাপোল রেলপথে একবার চলাচল করে। সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার বন্ধ থাকে। অথচ চালুর সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রকল্পটি চালু হওয়ায় মোংলা বন্দরের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ স্থাপন ছাড়াও ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ বিভিন্ন দেশে পণ্য পরিবহন সহজ হবে। গতিশীল হবে বন্দর। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই পথে পণ্যবাহী ট্রেন চালু হয়নি। ফলে কোনও ধরনের পণ্য পরিবহনও হয়নি।

তবে উদ্বোধনের পর থেকে পণ্য পরিবহন কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে আছে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, দেড় বছরে মাত্র তিনবার পণ্য পরিবহন করা হয়েছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পাঁচ মাসে ১৫ দিন ১৫টি পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করেছে। এগুলো ছিল অনিয়মিত ট্রেন। এর মধ্যে দুটি গিয়েছিল সায়েদাবাদ ও ১৩টি যায় জয়পুরহাট। তার মধ্যে মোংলা বন্দর থেকে পণ্যবাহী ট্রেনে আমদানিকৃত চিটাগুড় বহন করা হয়েছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সাড়ে ৭ হাজার মেট্রিক টন, ২৩ মার্চ সাড়ে ৫ হাজার মেট্রিক টন এবং ২৫ জুন ৬ হাজার মেট্রিক টন পরিবহন করা হয়। আর আমদানিকারকরা ১২বার পণ্য পরিবহন করেছেন। তবে কত মেট্রিক টন পণ্য পরিবহন করা হলো, তা জানাতে পারেনি রেলওয়ে। ২৫ জুনের পর পণ্যবাহী ট্রেন চলেনি এই পথে। 

মোংলা রেলওয়ে স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত মাস্টার এস এম মনির আহমেদ বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১৫ ওয়াগন পণ্য মোংলা থেকে গেছে। এতে আয় হয় ১ কোটি ৬৯ লাখ ৩৮ হাজার ৬৪০ টাকা। যা গত দেড় বছরে যাত্রীবাহী ট্রেনের তিনগুণ। ভারতের রহমপুর থেকে ফ্লাইঅ্যাশ আনার সুযোগ রয়েছে ট্রেনে। মোংলা ইপিজেডে এর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় অনুমোদন না হওয়ায় এটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মোংলা থেকে মালবাহী ট্রেন নিয়মিত চালু হলে আয় বাড়বে। এজন্য প্রয়োজন বাধাগুলো শনাক্ত করে পদক্ষেপ গ্রহণ।’

মোংলা বন্দরের ব্যবসায়ীরা বলছেন, চার হাজার ২৬১ কোটি টাকায় খুলনা-মোংলা পথে চলে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন। কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল মোংলা বন্দরের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ স্থাপনের পাশপাশি বিভিন্ন দেশের সঙ্গেও পণ্য পরিবহন সচল করা। কিন্তু সেটি না হওয়ায় এই প্রকল্প এখন অচল হয়ে আছে। এত বিশাল বিনিয়োগের পরও প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত সুফল না আসায় হতাশ ব্যবসায়ীরা। দ্রুত পণ্যবাহী ট্রেন চালু হলে এখানের মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে, শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে এবং দক্ষিণাঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে।

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জেইন ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মো. সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, ‘মোংলা বন্দর ও রেলওয়ের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় না থাকায় এই রেলপথ এখনও পণ্য পরিবহনের মূলধারা গড়ে তুলতে পারেনি। অবকাঠামো আছে, কিন্তু সমন্বয় নেই। ফলে সম্ভাবনা কাজে লাগছে না। মোংলা বন্দরের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও বড় আকারের জাহাজ প্রবেশে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় আমদানিকারকরাও পণ্য পরিবহনে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বন্দরে আধুনিক ক্রেন, গুদাম ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং সুবিধার ঘাটতি থাকার পাশাপাশি পণ্য খালাস ও পরিবহন প্রক্রিয়ায় ধীরগতি ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহিত করছে। এগুলো সমাধান করা জরুরি।’

তবে রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, তারা পণ্যবাহী ট্রেন চালাতে প্রস্তুত আছেন। কিন্তু বন্দরের সীমিত আমদানি কার্যক্রমের কারণে পণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। পণ্য পরিবহন বাড়লে ট্রেন চালানো যাবে। আমদানিকারকদের আগ্রহী করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। শিল্প এলাকা, রফতানিকারক ও আমদানিকারকদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করার পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে ট্রেনে পণ্য পরিবহনে আগ্রহী হন তারা।

রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘আমরা মালবাহী ওয়াগন ও ইঞ্জিনসহ সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। কিন্তু পর্যাপ্ত পণ্য না থাকায় নিয়মিত ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। মোংলা বন্দরে পণ্য প্রবাহ বাড়লেই নিয়মিত ট্রেন চালানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে রেলওয়ে।’

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমদানি কার্যক্রম বাড়াতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও বন্দর টার্মিনাল সম্প্রসারণের কাজ চলছে। আমদানিকারকদের উৎসাহিত করতে বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়ও বিবেচনায় আছে। আসলে পণ্য প্রবাহ বাড়লে ট্রেন নিয়মিত চালানো যায়। না হয় লোকসান হয়।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘খুলনা-মোংলা রেলপথ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারতো। কিন্তু রেলপথে নিয়মিত পণ্য পরিবহন শুরু না হলে এই বিনিয়োগ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না। সরকারকে এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। যাতে বন্দর, রেলওয়ে ও বাণিজ্যিক অংশীদাররা একই ছাতার নিচে কাজ করতে পারে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এই রেলপথটা তৈরি করেছি ঋণের টাকায়। ফলে প্রতিনিয়ত সুদের পরিমাণ বাড়ছে। এই রেলপথকে লাভজনক করতে হলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। এ অঞ্চলে শিল্পনগরী, রফতানিমুখী অর্থনীতি ও কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য রেলপথটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পণ্য পরিবহন কার্যক্রম শুরু হলে শুধু মোংলা নয়, পুরো দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।’

রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা সুজিত কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘মোংলা বন্দরের সঙ্গে ভারত ও নেপালের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করার চিন্তা থেকেই রেলপথটি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু মোংলা বন্দর দিয়ে ১৮টি পণ্য আমদানি হয়। যা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যায় রেলপথ ছাড়াই। ফলে মালবাহী ট্রেন নিয়মিত চালু করা যাচ্ছে না। এজন্য পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি আমরা।’

প্যা.ভ.ম