শিরোনাম
Passenger Voice | ১২:৫৯ পিএম, ২০২৫-১০-২৩
ব্যাংকগুলোর সুদ-স্বার্থ কৌশলের নীরব ফাঁদে পড়েছে রপ্তানি খাতের জন্য গঠিত ১০ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি সহায়ক প্রাক্-অর্থায়ন তহবিল (ইএফপিএ)।
২০২৩ সালের শুরুতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এই তহবিল তৈরি করেছিল রপ্তানিকারকদের স্বল্প সুদে মূলধন জোগাতে, যাতে বৈশ্বিক মন্দা ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকটেও উৎপাদন অব্যাহত থাকে। কিন্তু দুই বছর পেরোতেই এই তহবিলের সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা এখন পড়ে আছে অচল অবস্থায়, যা ব্যাংকের খাতায় জমে থাকা এক নিষ্ক্রিয় অঙ্কে পরিণত হয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) সংকুচিত হওয়ার পর ইএফপিএকে আশা করা হচ্ছিল তার বিকল্প হিসেবে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর আচরণে এর ভিন্ন চিত্রই ফুটে উঠছে। তারা এই সহায়তা প্রকল্পে অংশ নিতে প্রায় কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বরং নিজেদের তহবিল থেকে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ সুদে ঋণ দিতেই বেশি আগ্রহী, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি সহায়ক এই বিশেষ তহবিল থেকে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া সম্ভব। ফলে উদ্যোক্তারা পড়েছেন এক অদ্ভুত সংকটে—রাষ্ট্রের ঘোষিত প্রণোদনা কাগজে-কলমে আছে, কিন্তু বাস্তবে তার সুফল মেলে না।
একজন রপ্তানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো আমাদের বলে, ইএফপিএ ঋণ এখন বন্ধ; কিন্তু একই ব্যাংক পরদিন তাদের নিজেদের তহবিলের ঋণ অফার করে ১৫ শতাংশ সুদে। এটা নিছক ব্যবসায়িক স্বার্থ নয়, এটা পলিসির অপব্যবহার।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, তহবিলের মোট অর্থের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশই এখন ব্যাংকগুলো ব্যবহার করছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেও ব্যাংকগুলো সেই টাকা রপ্তানিকারকদের দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তারা টাকা নিজেদের কাছে ধরে রেখেছে, বিতরণ করছে না।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই তহবিল রপ্তানিকারকদের জন্য লাইফলাইন হওয়ার কথা ছিল। অথচ ব্যাংকগুলো এটাকে নিজেদের সুবিধার খাতায় ফেলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মনিটরিং না থাকলে এভাবে সরকারি প্রণোদনা মাঠে নামবে না।’
বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে দুটি বাস্তব কারণ কাজ করছে—এক, ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদের ঋণে লাভ বেশি পায়; দুই, তহবিল বিতরণে কোনো বাধ্যবাধকতা বা জরিমানা না থাকায় তারা নির্লজ্জভাবে অলস রাখছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম মনে করেন, এটা অর্থনীতির একধরনের ‘নীরব ব্লকেজ’। ব্যাংকগুলো জানে, তারা চাইলেও না দিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে না। ফলে এই অর্থ কার্যত একধরনের সুদ-অপচয় চক্রে ঘুরছে।
অন্যদিকে ব্যাংক খাতে এখন তারল্যের কোনো সংকট নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থের ঘাটতি নয়, বরং প্রণোদনা তহবিল ব্যবহার না করার পেছনে আছে সুদ-স্বার্থের মানসিকতা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘রপ্তানি সহায়তার এই সস্তা ঋণের অর্থ যদি অলস পড়ে থাকে, তাহলে তহবিল গঠনের লক্ষ্যই ব্যর্থ হবে। এতে শুধু রপ্তানিকারকেরাই নয়, পুরো দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো ব্যাংক যদি ইচ্ছাকৃতভাবে এই তহবিলের ঋণ বিতরণে গড়িমসি করে এবং পরিবর্তে নিজেদের উচ্চ সুদের ঋণ চাপিয়ে দেয়, তবে ব্যবসায়ীরা যেন সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ জানান। আমরা তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।’
তবে ব্যাংকারদের একাংশ বলছেন, তহবিলের শর্ত জটিল এবং ফেরত দেওয়ার সময়সীমা কম। এ কারণে তাঁরা ঝুঁকি নিতে চান না। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি ব্যাংকগুলোর সুবিধাবাদী ব্যাখ্যা। কারণ, ইএফপিএ ঋণের ঝুঁকি অনেকটাই বাংলাদেশ ব্যাংক বহন করে; তবু তারা দিতে চায় না।
ফলে এখন এই তহবিলের উদ্দেশ্য পুরোপুরি ব্যর্থতার মুখে। রপ্তানিকারকেরা যেখানে কাঁচামাল আমদানির জন্য মূলধন না পেয়ে উৎপাদন কমাচ্ছেন, ব্যাংকগুলো সেখানে অলস অর্থের ওপর ভর করে উচ্চ সুদের ঋণ বিক্রিতে মনোযোগী।
ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ‘ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে রপ্তানির বিশেষ তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে না, এমন তথ্য আমার কাছে নেই।’
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2019 - 2025 PassengerVoice | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ
Developed By Muktodhara Technology Limited.
পাবলিক মতামত