মোটরযান পরিদর্শক ওমর ফারুকের বদলী নিয়ে সমালোচনার ঝড়

তথ্য বিভ্রাটে বিআরটিএ'র দুর্নীতিবাজ কর্তাদের পদায়ন হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সার্কেলে

Passenger Voice    |    ০৫:২২ পিএম, ২০২৫-১০-০৮


তথ্য বিভ্রাটে বিআরটিএ'র দুর্নীতিবাজ কর্তাদের পদায়ন হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সার্কেলে

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর বর্তমান চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দীন আহম্মেদ সংস্থাটির সেবার মানোন্নয়নে যারপরনাই চেষ্টা করছেন। পরিদর্শন ছাড়া গাড়ীর ফিটনেস সনদ প্রদান বন্ধে চেয়ারম্যানের অবদান অনস্বীকার্য। তুলনামূলক ভাবে বিআরটিএতে কমেছে ঘুষ ও তদবির বাণিজ্য এবং দালালের দৌরাত্ম্য। পেশাদার চালকের দক্ষতা ও মানোন্নয়নে ইতিমধ্যে শুরু করেছে চালকদের ডাটাবেজ। নারায়নগঞ্জ জেলায় প্রথম সরকারী অর্থায়নে চালক ও হেলপারদের দিচ্ছে আলাদা পোষাক। সড়কে লাশের মিছিল থামাতে দক্ষ চালক তৈরির জন্য আন্তঃর্জাতিক মানের ড্রাইভিং স্কুল প্রতিষ্টায় নিয়েছেন সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা। তবে তথ্য বিভ্রাটে কতিপয় দুর্নীতিবাজরা বদলী হয়ে যাচ্ছে বিআরটিএর গুরুত্বপূর্ণ সার্কেলে। 

সংস্থাটির এইসব দুর্নীতিবাজদের তালিকায় রয়েছে বাগেরহাট সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক  মো. ওমর ফারুক। ২০২৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর ও ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারী ইফাদ অটোস্ লিমিটেড এর কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে অবৈধ ভাবে অনুনমোদিত স্লিপার বাসের নিবন্ধন দিয়েছিলেন তিনি। ইফাদ অটোস্ লিমিটেডের স্বার্থ রক্ষায় দেশের যাত্রী ও পথচারীকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছে। সেই স্লিপার বাসের নিচে চাপা পরে বারবার মরছে সাধারণ মানুষ । তৎকালীন কর্তৃপক্ষ এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় বর্তমান বিআরটিএর প্রশাসন বিভাগ তথ্য বিভ্রাটে পড়েছে। 

আজ ৮ অক্টোবর বুধবার বিআরটিএর উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. হেমায়েত উদ্দিন স্বাক্ষরীত নং- ৩৫.০৩.০০০০.০০০.০০১.১৯.০১০৮.২৫-২১২৩ সংক্ষক স্মারকমূলে বিআরটিএর এই মোটরযান পরিদর্শক মো. ওমর ফারুককে বিআরটিএর গুরুত্বপূর্ণ সার্কেল সাতক্ষীরা জেলায় বদলী করেছেন। আদেশটি দেখে বিস্মিত হয়েছে বিআরটিএর অন্যান্য কর্মকর্তারা।  খোদ হতভাক বাংলাদেশ পুলিশও। 

বাংলাদেশ পুলিশের কুমিল্লা রিজিয়নের মিয়াবাজার হাইওয়ে থানা উপ পুলিশ পরিদর্শক(নিরস্ত্র) চন্দন কান্তি দাশ প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, যশোর-ব-১১-০২৫১ সিরিজের একটি বাস সাম্প্রতিক থানা এলাকায় ৬০ বছর বয়সি এক মহিলাকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলে তিনি মারা যান। সড়ক পরিবহন আইনের ১০৫ ধারা মোতাবেক কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম থানায় একটি মামলা রুজু করা হয়।  মামলা নং- ০৬/৩১৫, তারিখঃ ০৬-০৮-২০২৫।  পুলিশের এই কর্মকর্তা প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে আরো বলেন, গাড়িটির মালিকানা যাচাই-বাচাই করতে ইতিমধ্যে বিআরটিএ ও ইফাদ অটোস লিমিটেডকে চিঠি দিয়েছেন তিনি। 

বিআরটিএর কুমিল্লা সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, গত কয়েকদিন আগে মিয়াবাজার হাইওয়ে থানা উপ পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) চন্দন কান্তি দাশের স্বাক্ষরিত এক পত্রে তিনি যশোর-ব-১১-০২৫১ নং বাসের মালিকানা সংক্রান্ত তথ্য চেয়েছেন। 

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ঘাতক এই গাড়িটি এর আগে ২০২৪ সালের ১৭ মে মিয়াবাজার হাইওয়ে থানাধীন চৌদ্দগ্রাম এর বসন্তপুর নামক স্থানে দুর্ঘটনায় পড়েছিল। এই ঘটনায় ৫ জন নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছিল  হাইওয়ে পুলিশ কুমিল্লা রিজিয়নের তৎকালিন অতিরিক্ত ডিআইজি মো: খাইরুল আলম । 

মিয়াবাজার হাইওয়ে থানা পুলিশের সূত্র বলছে,  রিলাক্স পরিবহনের এই স্লিপার বাসটি ২০২৪ সালের ১৭ মে রাত আনুমানিক ১২ টা ৪০ মিনিটে ঢাকার আরামবাগ হতে কক্সবাজার জেলার উদ্দেশ্যে রওনা করে। সকাল  ৬ টার দিকে কুমিল্লার কোটবাড়ি বিশ্বরোডে হোটেল শাহজাহানে রিলাক্স পরিবহন বাসটি ২০/২৫ মিনিটের যাত্রা বিরতির পর কক্সবাজার জেলার উদ্দেশ্যে পুনরায় যাত্রা শুরু করে এবং মিয়াবাজার হাইওয়ে থানাধীন চৌদ্দগ্রাম এর বসন্তপুর নামক স্থানে রিলাক্স পরিবহন যার রেজিষ্ট্রেশন নং যশোর-ব-১১-০২৫১ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার বাম পাশে বাঁশঝাড়ে নামিয়ে দিলে গাড়িটি বাম দিকে কাঁত হয়ে পড়ে এবং গাড়ির নিচে চাপা পড়ে গাড়িতে থাকা সুপারভাইজার ও হেলপারসহ সর্বমোট ৫ জন নিহত হয়। 

উক্ত ঘটনায় দুর্ঘটনা কবলিত স্লিপার কোচ বাসটি পরিদর্শনে যায় বিআরটিএ কুমিল্লা সার্কেলের কর্মকর্তা মোটরযান পরিদর্শক সাইফুল কবীর ও মেকানিক্যাল এসিস্ট্যান্ট মিনহাজ উদ্দীন। সেই সময়ে দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে কুমিল্লা সার্কেলের সাবেক মোটরযান পরিদর্শক সাইফুল কবীর (বর্তমানে নারায়নগঞ্জ সার্কেলে কর্মরত) বলেছেন, স্লিপার কোচ বাসটির আসন বিন্যাস সঠিক ছিল না। বাসটিতে ঝুলন্ত কিছু আসন সন্নিবেশিত ছিলো, যা অনুমোদিত ছিলোনা। দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে স্পষ্ট যে, স্লিপার বাসটি বিআরটিএ‘র টাইপ এপ্রোভালের সাথে নিবন্ধিত বাসের আসন বিন্যাস গরমিল ছিলো, গাড়িটি পরিদর্শন ব্যতীত চ্যাসিস নম্বরের উপর মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে রেজিষ্ট্রেশন প্রদানের জন্য পরিদর্শন রিপোর্ট দিয়েছিল এই মোটরযান পরিদর্শক ওমর ফারুক।

২০২৪ সালের ১৭ মে দুর্ঘটনার সময় কুমিল্লা সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) ফারুক আলম কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে স্টেশন ত্যাগ করে রংপুরের নিজ বাড়িতে অবস্থান করায় তৎকালিন বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার কারণ দর্শানোর পত্র দিলে তিনি ক্ষমা চেয়ে পার পেয়েছিলেন। 

এই বিষয়ে যশোর সার্কেলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিআরটিএর যশোর সার্কেলে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর ও ২০২৪ সালের জানুয়ারীতে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে যশোর-ব-১১-০২৫০, যশোর-ব-১১-০২৫১, যশোর-ব-১১-০২৫২, যশোর-ব-১১-০২৫৩, যশোর-ব-১১-০২৫৪, যশোর-ব-১১-০২৫৫, যশোর-ব-১১-০২৫৬, যশোর-ব-১১-০২৫৭, যশোর-ব-১১-০২৫৮, যশোর-ব-১১-০২৫৯, যশোর-ব-১১-০২৬০, যশোর-ব-১১-০২৬১ নাম্বারের স্লিপার বাসের নিবন্ধন দেওয়ার জন্য পরিদর্শন রিপোর্ট দিয়েছিলেন এই মোটরযান পরিদর্শক ওমর ফারুক। 

বিআরটিএর সদর কার্যালয়ের সূত্র বলছে, সংস্থাটির মোটরযান পরিদর্শক মো. ওমর ফারুক কুষ্টিয়া সার্কেল থেকে ২০২১ সালের দিকে যশোর সার্কেলে বদলী হয়েছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট সরকার পরিবর্তনের ফলে ০৭ নভেম্বর নম্বর-৩৫.০৩.০০০০.০০১.১৯.১৩২.২৩-১৮৪৯ সংক্ষক স্মারকমূলে ৩৭ জন মোটরযান পরিদর্শককে এক সার্কেল থেকে অন্য সার্কেলে বদলী করেন কর্তৃপক্ষ। সেই আদেশে মোটরযান পরিদর্শক মো. ওমর ফারুক (পরিচিতি নং- ২০১১---০৬৩) কে যশোর সার্কেল থেকে সুনামগঞ্জ সার্কেলে বদলী করেছিলেন বিআরটিএর সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ ইয়াসীন (গ্রেড-১)।  তবে আদেশটি তার পছন্দ না হওয়ায় তিনি বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে বিভিন্ন ভাবে চাপ সৃষ্টি করে সুনামগঞ্জ জেলার বদলী আদেশ বাতিল করিয়ে নেন।  এদিকে ১৯ ডিসেম্বর নম্বর-৩৫.০৩.০০০০.০০১.১৯.১৩২.২৩-২১২৪ সংক্ষক স্মারকের আদেশে বিআরটিএর খুলনা সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক সাইফুল ইসলামকে বাগেরহাট সার্কেলের অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন। তবে অসহায় হয়ে সাবেক চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন ওমর ফারুককে পুনরায় চলতি বছরের ১২ জানুয়ারী নম্বর-৩৫.০৩.০০০০.০০১.১৯.১৩২.২৩-৯৪ সংক্ষক স্মারকমূলে একটি আদেশ জারি করে সাইফুল ইসলামের দায়িত্ব বাতিল করে মো. ওমর ফারুকের পছন্দে তাকে বাগেরহাট সার্কেলে  বদলী করেন। আদেশ প্রকাশিত হওয়ার পরে সাবেক চেয়ারম্যান তার জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পায় । 

এদিকে বাগেরহাট সার্কেলে বদলীর ২৬৮ দিনের মাথায় আবারো পছন্দের সার্কেল সাতক্ষীরা জেলায় ওমর ফারুককে বদলী করতে বাধ্য হয়েছে বিআরটিএর প্রশাসন বিভাগ। যা ইতিমধ্যে সমালোচিত হয়েছে। বিআরটিএর অনেকে বলছে এই মোটরযান পরিদর্শকের কব্জিরজোর এত বেশি যে তার বদলীতে দায়িত্বপ্রাপ্ত শীর্ষ কর্তারা নীতিমালা অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়।   

এই বিষয়ে জানতে বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শক ওমর ফারুকের মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া সম্ভব হয়নি।