ইলেকট্রিক ভেহিকল শিল্প উন্নয়ন খসড়া নীতিমালা

নিবন্ধন পাচ্ছে ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার

Passenger Voice    |    ০২:৩৯ পিএম, ২০২৫-১০-০৫


নিবন্ধন পাচ্ছে ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার

বাংলাদেশে ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক) চলছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। এ দীর্ঘ সময়েও বাহনটি আমদানি কিংবা চলাচলে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারেনি সরকার।

বাংলাদেশে ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক) চলছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। এ দীর্ঘ সময়েও বাহনটি আমদানি কিংবা চলাচলে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারেনি সরকার। এ সুযোগে অবাধে বেড়েছে ইজিবাইকের সংখ্যা। সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও ২০২২ সালে বাহনটির চলাচল নিয়ন্ত্রণ আরোপের লক্ষ্যে উচ্চ আদালতে করা এক রিট আবেদনে দেশে ৪০ লাখ ইজিবাইক থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।

দেশে থাকা বিপুলসংখ্যক ইজিবাইককে এবার নিবন্ধনের আওতায় আনা হচ্ছে। শিল্প মন্ত্রণালয় প্রণীত ‘ইলেকট্রিক ভেহিকল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা ২০২৫’-এর খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কর্তৃক নির্ধারিত মান ও টেস্টিং সম্পন্ন করে’ ইজিবাইকের নিবন্ধন দেয়া হবে। শিল্প মন্ত্রণালয় ছাড়াও থ্রি-হুইলার নিবন্ধন দিতে পৃথক একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), যার শিরোনাম, ‘বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০২৫’।

এর আগে নিরাপদ ও যাত্রীবান্ধব বিদ্যুচ্চালিত অটোরিকশা অনুমোদনের উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।

‘নিরাপদ’ ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলারের একটি মডেল তৈরি করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। বুয়েট যে নিরাপদ মোটরাইজড ব্যাটারিচালিত রিকশার মডেল তৈরি করেছে, সেটি মূলত ‘ইজিবাইক’-এর গঠন কাঠামোকে ভিত্তি করে। দেশে যে ইজিবাইকগুলো চলছে সেগুলোর আদলে রিকশায় হাইড্রোলিক ব্রেক, দুই পাশে দরজা, উইন্ডশিল্ড, ইন্ডিকেটর স্থাপনসহ বেশকিছু উপকরণ সংযুক্ত করা হয়েছে। ইজিবাইক নিয়েও কিছু কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

বুয়েটের এ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের (বিইপিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘বুয়েট তিন ধরনের কাজ করছে। এর একটা হলো বর্তমানে দেশে যেসব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা রয়েছে, যেগুলোকে আমরা ইজিবাইক বলি, বুয়েট সেগুলোর একটি মডিফায়েড ভার্সন তৈরি করেছে। এটির ব্রেকিং ব্যবস্থা উন্নত। চালক ও যাত্রীর জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।’

একটি ইজিবাইকের মানোন্নয়নে কম-বেশি ৩০ হাজার টাকা খরচ হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এর বাইরে তিন চাকার একটি পূর্ণাঙ্গ গাড়ির প্রটোটাইপ বুয়েট তৈরি করেছে। এ বাহনটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। প্রতিযোগিতামূলক দামে বাংলাদেশেই এটা উৎপাদন করা সম্ভব। তিন চাকার এ থ্রি-হুইলার ছাড়াও ফোর হুইলারেরও একটি প্রটোটাইপ তৈরি করা হয়েছে। এটা তৈরি করা হয়েছে মূলত গ্রামাঞ্চলের জন্য।’

দেশে বিদ্যুচ্চালিত মোটরযান নিবন্ধন ও চলাচলের জন্য ২০২৩ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে বিআরটিএ। ওই নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলারকে (ব্যাটারিচালিত রিকশা কিংবা ভ্যান ব্যতীত) বিদ্যুচ্চালিত মোটরযান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

বর্তমানে সড়ক-মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণের জন্য বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার ব্যবস্থাপনা নীতিমালা তৈরি করছে সংস্থাটি। মহাসড়কে বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার চলাচল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস ‘বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার ব্যবস্থাপনা নীতিমালা, ২০২৫’-এর অন্যতম উদ্দেশ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে থ্রি-হুইলার জাতীয় মোটরযানকে মহাসড়ক ব্যতীত নির্দিষ্ট এলাকায় চলাচলের জন্য নির্ধারিত সংখ্যাসীমার আওতায় নিবন্ধন দেয়া; নিবন্ধন ও ফিটনেস সনদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট এলাকায় চলাচলের অনুমতি সাপেক্ষে সুশৃঙ্খল এবং নিরাপদ সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার চালকদের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্সের আওতায় আনা।

দেশের পরিবহন খাতের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর এ উদ্যোগের মধ্যেই ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার নিয়ে নীতিমালা করতে উদ্যোগী হয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। বিদ্যুচ্চালিত মোটরযান শিল্পের প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে ইলেকট্রিক ভেহিকল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়নের কথা জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এ নীতিমালায় ‘বিপুলসংখ্যক’ ইজিবাইক নিবন্ধন দেয়ার কথা বলা হয়েছে।

খসড়া নীতিমালায় থ্রি-হুইলারসহ সব ধরনের বিদ্যুচ্চালিত মোটরযান শিল্পের যন্ত্রাংশ উৎপাদন ও প্রকৌশল ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে উৎকৃষ্ট মানের বিদ্যুচ্চালিত মোটরযান ও যন্ত্রাংশ উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিতের কথা। দেশে উৎপাদিত যন্ত্রাংশ বিদেশে রফতানির সুযোগ তৈরির ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

দেশে সড়ক পরিবহনসংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি হলেও এর দেখভাল ও বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হয় না বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘নীতিমালাটা সুখবর নয়। কেননা নীতিমালা তৈরির জন্য প্রয়োজনে পরামর্শদাতা (কনসালট্যান্ট) নিয়োগ দেয়া হলেও সে নীতি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা, তা দেখভালের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব ভূমিকা থাকে না।’

ড. সামছুল হক বলেন, ‘শহরে দূষণের মাত্রা কমানোর উপায় হিসেবে শিল্প মন্ত্রণালয় একদিকে বৈদ্যুতিক যানবাহনের প্রচলনের চেষ্টা করছে, অন্যদিকে তারাই আবার পুরনো বা মেরামত করা (রিকন্ডিশন্ড) গাড়ি আমদানির সময়সীমা পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর পর্যন্ত করেছে।’

এদিকে নীতিমালা বাস্তবায়নে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে মোটর চার্জিং স্টেশন ও ব্যাটারি ব্যবহারের নির্দেশনা এবং তদারকি ও পর্যালোচনার জন্য কয়েকটি স্তরে কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়। এ নীতিমালা কার্যকর হলে দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা এবং পরিবহন ব্যবস্থার উদ্দেশ্যগুলো নতুন করে বিবেচনা করতে হবে বলে মনে করেন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‍্যাপিড) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘পুরনো ব্যাটারিগুলো কোথায় নিষ্পত্তি করা হবে এবং সেগুলো পুনর্ব্যবহারের সুবিধা দেশে আছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। বিশ্বজুড়ে অনেক দেশ এখন ইলেকট্রিক শিল্পে বিনিয়োগ করছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার কারণে পরিবেশবান্ধব পণ্য এখন অনেক কম দামে পাওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে বৈদ্যুতিক যান তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী। ফলে কম দামে এগুলো আমদানি করা যাবে।’

এদিকে খসড়া নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, ইলেকট্রিক শক বা অন্য কোনো ঝুঁকি এড়াতে মোটরযানের ব্যাটারি বা সরঞ্জামাদি এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় যাত্রীদের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। ইলেকট্রিক ভেহিকল শিল্প উন্নয়নে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা প্রদানসহ যন্ত্রাংশ রফতানি করতে নগদ সুবিধা দেয়া হবে। এছাড়া নীতিমালা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও পর্যালোচনার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার নেতৃত্বে কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে।