শিরোনাম
Passenger Voice | ১১:৪৫ এএম, ২০২৫-১০-০৪
২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে উড়োজাহাজের টিকিটের বেশি দাম নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগ ছিল। এখন এই অভিযোগ আরও বেড়েছে। গত বছরের জুলাইয়ের পর থেকে দুষ্টচক্রের কারসাজি, ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে দেশি-বিদেশি বিমানের টিকিটের দাম দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া চার দেশের ভিসা ফি বেড়েছে। বাংলাদেশিদের জন্য ভিসার দরজা বন্ধ হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের পাশাপাশি ভারতসহ এশিয়ার অন্য চারটি দেশের। যদিও ভারত সম্প্রতি চিকিৎসা ভিসা চালু করেছে। কিন্তু কূটনৈতিক জটিলতায় ভ্রমণ ভিসা এখনো চালু হয়নি।
বিদেশযাত্রার সংখ্যা কমার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জাল কাগজপত্র জমা দেওয়া, ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও অতিরিক্ত সময় অবস্থান করা এবং অন্য অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িত থাকা। এ ছাড়া অনেক দেশে ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়েছে, যা বিদেশযাত্রা কমাতে ভূমিকা রেখেছে।
ট্রাভেল এজেন্সি ও পর্যটনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বড় অংশ সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, মালয়েশিয়াসহ আশপাশের দেশে বছরে বা দুই বছরে একবার ঘুরতে যেতেন। কিন্তু ভিসা ফি ও টিকিটের দাম বাড়ায় এখন তারা যাচ্ছেন না। অনেকেই ওই সব দেশের বদলে এখন দেশের বিভিন্ন রিসোর্টে বেড়াতে যাচ্ছেন। ট্রাভেল এজেন্টদের শীর্ষ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশ (আটাব)-এর সদস্য মো. গোলাম মহিউদ্দিন খবরের কাগজকে জানান, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে আগের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ কম যাচ্ছেন। এর মধ্যে যেমন রয়েছেন পর্যটকরা, তেমনি রয়েছেন বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রত্যাশীরা।
আকিব ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুর লিমিটেডের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, কুয়েত ও ওমানে ওয়ার্ক পারমিট বন্ধ রয়েছে। এগুলো চালু করার ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে দেশের রেমিট্যান্স খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে।
টিকিট ও ভিসা ফি বাড়ার কারণে এভিয়েশন খাতও বেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ ইমেজ-সংকটে পড়বে ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া ভিসার অপব্যবহার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে বলেও তারা মনে করেন। ব্যবস্থা না নেওয়া হলে বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্য বৈশ্বিক ভ্রমণের দুয়ার আরও সংকুচিত হয়ে পড়বে বলে তারা আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।
বিমান পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম বলেন, বিমানের অসাধু কর্মকর্তারা টিকিট ব্লক করে রেখে কিছু নির্দিষ্ট ট্রাভেল এজেন্সির কাছে বিক্রি করে ব্যক্তিগভাবে লাভবান হন।
তিনি বলেন, টিকিটের চাহিদা থাকলে দাম বাড়বে। তবে কিছু অসাধু লোকের কারণেও টিকিটের অস্বাভাবিক দাম বাড়ে। অনেক ট্রাভেল এজেন্সি এই টিকিট সিন্ডিকেট করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। সিন্ডিকেট করা এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তার মতে, গ্রুপ টিকিট সিন্ডিকেট যারা করে তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। তা না হলে এই অপরাধ বাড়বে ও মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
কাজী ওয়াহেদুল আলম আরও জানান, টিকিটের দাম বাড়ার কারণগুলির মধ্যে রয়েছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত ল্যান্ডিং ও পার্কিং চার্জ, বিমান বাংলাদেশের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ বৃদ্ধি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অতিরিক্ত ট্রাভেল ট্যাক্স, আবগারি শুল্ক এবং জেট ফুয়েলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। এই বিষয়গুলি সম্মিলিতভাবে টিকিটের মূল্যের উপর প্রভাব ফেলেছে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, ‘দেশীয় বিমান সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। বাংলাদেশে বিমান ভাড়া বেশি হওয়ার কারণে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলি এখানে ব্যবসার সুযোগ নিচ্ছে। তাই, অভ্যন্তরীণ বিমান সংস্থাগুলির উন্নতি এবং তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরি। এতে, ভাড়া কমানো সম্ভব হবে এবং বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলির উপর নির্ভরতা হ্রাস পাবে এবং দেশের বিমান পরিবহন খাতে স্থিতিশীলতা আনবে।‘
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আকাশপথে যাত্রীদের স্বার্থ রক্ষায় উড়োজাহাজের টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধে ১০টি নির্দেশনা জারি করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। তবে বছর শেষ হতে চললেও এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি চোখে পড়েনি। এসব নির্দেশনায় রয়েছে- অনতিবিলম্বে গ্রুপ টিকিট বুকিংসহ যেকোনো টিকিট সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর এবং পাসপোর্টের ফটোকপি বাধ্যতামূলকভাবে সংযুক্ত করা। বুকিংয়ের তিন দিনের মধ্যে নির্দিষ্ট যাত্রীর নামে টিকিট ইস্যু না হলে ৭২ ঘণ্টা পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা বাতিল হয়ে যাওয়া। এ ছাড়া টিকিটের প্রকৃত মূল্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে এবং তা ওয়েবসাইট, অনলাইন ও টিকিটের গায়ে উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু নির্দেশনার কথা উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বিমান) মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, চলতি বছরের শুরু থেকে উড়োজাহাজের টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধে কাজ করছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি মিটিংও হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের জারি করা নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের এয়ারলাইনস ব্যবসায়ী ও দেশীয় কিছু ট্রাভেল এজেন্সি মিলে প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। বিভিন্ন এজেন্সি চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও যাত্রীদের পাসপোর্ট, ভিসা ও ভ্রমণ নথিপত্র ছাড়াই শুধু ই-মেইলের মাধ্যমে কিছু এয়ারলাইনসের সিট বুক করে রাখে। প্রায় তিন মাস আগে থেকেই তারা এ কাজটি করে। এয়ারলাইনসগুলোর টিকিট আগে ব্লক করে রেখে তারা ইচ্ছামতো দাম বাড়ায়। এ কারণে টিকিট-সংকট তৈরি হয় ও বিদেশগামী যাত্রীদের স্বাভাবিক ভাড়ার তিন গুণ পর্যন্ত বেশি টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে হয়। সিন্ডিকেটের কারণে ৬০-৭০ হাজার টাকার টিকিট কিনতে হয়েছে দেড় লাখ কিংবা তারও বেশি টাকায়।
সিন্ডিকেটের কারণে ঢাকা-মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, সৌদি আরব, ইউরোপসহ যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যে বিমান ভ্রমণের ক্ষেত্রে গুনতে হয় বাড়তি ভাড়া। যদি আগে থেকে টিকিট বুকিং দেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে ঢাকা-মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড আসা-যাওয়ার খরচ হবে সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার থেকে ৪৫ হাজার। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর যেতে সর্বনিম্ন খরচ ৫৫ হাজার, ইউরোপে লাখের মধ্যে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে যেতে লাখ টাকার ওপর ভাড়া গুনতে হবে। তবে গ্রুপ টিকিট সিন্ডিকেটের কারণে এই ভাড়া অনেক সময় দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যায়।
উড়োজাহাজের আকাশচুম্বী ভাড়া
আটাব জানায়, বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি ও এয়ারলাইনসের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা মিলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। গ্রুপ তৈরি করে বিপুল পরিমাণ টিকিট আগাম বুকিং দিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। পরে যাত্রীরা আর টিকিট পান না।
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বোসরা ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ বিমানে কোনো ভাড়া বাড়েনি। তবে ট্রাভেল ট্যাক্স বাড়ার কারণে খরচ বেড়েছে। এ ছাড়া আমাদের অভ্যন্তরীণ রুটেও ভাড়া বাড়েনি। বরং বিমান এ খাতে লোকসান গুনছে।’
জানতে চাইলে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো উৎসবে আমাদের বিমানের ভাড়া বাড়ানো হয় না। চেষ্টা করা হয় যাত্রীরা যেন প্রতারিত বা বঞ্চিত না হন। তবে বিমানের টিকিটের ক্ষেত্রে একটি বিষয় অবশ্যই আপনি জানেন, আগে থেকে বুকিং দিলে দাম নাগালের মধ্যে থাকে। তবে যদি জরুরিভাবে বুকিং দেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে দাম বেড়ে যায়।’
উড়োজাহাজের আকাশচুম্বী ভাড়া, ভিসা ফি বেড়ে যাওয়া ও বেশ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিজনেস ভিসায় দেশের বাইরে ভ্রমণ করা সোনালী ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী শাহজাহান কবির লিটন। তিনি বলেন, বিদেশ ভ্রমণ বাংলাদেশিদের জন্য অনেক জটিল হয়ে যাচ্ছে। এখন দূতাবাসগুলো বিজনেস ও ফ্যামিলি ভিসা ছাড়া অন্য ভিসা আগের চেয়ে কম দিচ্ছে।
বিমানের ভাড়া অস্বাভাবিকভাবে বাড়ায় তিনি বিব্রত হয়েছেন জানিয়ে বলেন, দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে যে পরিমাণ ট্রাভেল ট্যাক্স এবং এক্সাইজ ডিউটি নেওয়া হয়, সে তুলনায় বাংলাদেশে কয়েক গুণ বেশি নেওয়া হয়। এটিও ভাড়া বাড়ার আরেকটি কারণ বলে তিনি মনে করেন।
৪ দেশের ভিসা ফি বেড়েছে ও ৮ দেশের দুয়ার বন্ধ
একাধিক ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেল কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারত, দুবাই, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া এই চারটি দেশের ট্যুরিস্ট ভিসা সম্পূর্ণ বন্ধ আছে। এ ছাড়া সম্প্রতি ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স ও চীন এই চারটি দেশের ভিসা ফি বাড়ানো হয়েছে। থাইল্যান্ডের ভিসা ফি ছিল ৫ হাজার ও ফিলিপিন্সের সাড়ে ৬ হাজার টাকা। থাইল্যান্ডের ভিসা ফি ৫০০ ও ফিলিপিন্সের দেড় হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে চীনের ভিসা ফি ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া সৌদি আরবে ওমরাহ ভিসা ফি ২৪ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২৮ হাজার টাকা করা হয়েছে। গ্রুপ টিকিট সিন্ডিকেটের কারণে সব দেশে উড়োজাহাজের ভাড়া অস্বাভাবিক বেড়েছে। থাইল্যান্ডে যাওয়ার টিকিটে আগের তুলনায় দাম অনেক বেশি নেওয়া হচ্ছে, যা প্রায় ২৫ থেকে ৪৫ শতাংশ বা তার বেশি বলেও জানিয়েছেন একাধিক ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেল কোম্পানির মালিক।
এ বিষয়ে মার্লিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলের কর্মকর্তা জুনায়েদ আল-আদনান বলেন, ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসায় নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বাজারে উচ্চ প্রতিযোগিতা ও অনলাইন বুকিং প্ল্যাটফর্মের কারণে গ্রাহক ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। এয়ারলাইনস ও হোটেল থেকে কমিশন কমে যাওয়ায় লাভ কমে যাচ্ছে। আবার ভুয়া এজেন্সির কারণে গ্রাহকের মাঝে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া ভিসা ও আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং ব্যবসাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। সূত্র খবরের কাগজ
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2019 - 2025 PassengerVoice | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ
Developed By Muktodhara Technology Limited.
পাবলিক মতামত