মানচিত্র থেকে বিলীন ১৩ নদী

Passenger Voice    |    ০৫:৪৩ পিএম, ২০২৫-০৯-২৯


মানচিত্র থেকে বিলীন ১৩ নদী

একসময় প্রবল স্রোতধারা বইত ঠাকুরগাঁওয়ের টাঙ্গন, শুক ও সেনুয়া নদীতে। সেই নদীগুলো আজ যেন পরিণত হয়েছে মৃতপ্রায় খালে। খননের অভাব, দখল আর অব্যবস্থাপনার কারণে এ অঞ্চলের নদীগুলো দ্রুত সংকুচিত হয়ে পড়ছে। কোথাও হাঁটুজল, কোথাও আবার সম্পূর্ণ শুকনো জমি। নদী ভরাট করে গড়ে উঠছে বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ফলে হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ ও মানুষের জীবিকা।

সম্প্রতি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জেলার নদ-নদীর তালিকা হালনাগাদ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ৫০ বছরে জেলার অন্তত ১৩ নদী মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে গেছে। নদীগুলো হলো রশিয়া, হাতুড়ি, জলই, পুনর্ভবা, মরা গোগরা, চাড়াল বান্দ, নহনা, আমান-ধামান, কাহালাই, বাগমারা, সারডুবি, মরাটাঙ্গন ও ভক্তি। একসময় এসব নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত, নৌকায় চলাচল হতো। এখন সেখানে কেবল স্মৃতি আর শুকনো ফসলের জমি।

সদর উপজেলার ভেলাজান এলাকার স্কুলশিক্ষক রফিকুল ইসলাম (৬৫) বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনেছি এসব নদীতে বড় বড় লঞ্চ চলত। জেলেরা মাছ ধরে সংসার চালাতেন। এখন শুধু ধুলো উড়ছে।’

পুরো জেলার বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে দেখা যায়, নদীর বুক ভরাট হয়ে জমিতে চাষাবাদ চলছে। কোথাও সামান্য পানি থাকলেও তার ওপর দৃষ্টি পড়েছে দখলদারদের। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়েছে জেলেদের জীবিকা, কৃষকরাও পড়েছেন সেচ সংকটে।

রুহিয়া ইউনিয়নের কৃষক আবদুস সালাম বলেন, ‘আগে নদীর পানি দিয়েই সেচ হতো। এখন নলকূপই ভরসা। এ কারণেই খরচও বেড়ে গেছে।’ একই এলাকার জেলে ছাবেদ আলী আক্ষেপ করে বলেন, ‘নদীতে নামলে শুধু বালু আর চর দেখা যায়। মাছ ধরার দিন শেষ হয়ে গেছে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, ঠাকুরগাঁও জেলায় ৩৬টি নদী ও খালের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৭০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ৬ দশমিক ৩৯৬ একর নদীর জমি এরই মধ্যেই দখল হয়ে গেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, নদীর জমি দখল করে প্রভাবশালী মহল ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও মিল-কারখানা গড়ে তুলছে। এতে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সেনুয়া এলাকার গৃহবধূ ষাটোর্ধ্ব ফাতেমা বেগম বলেন, ‘আগে নদীর পানি দিয়েই রান্না করতাম, কাপড় ধুতাম। এখন নদী দখল হয়ে গেছে। পানিও আর আগের মতো নেই। গ্রীষ্মে প্রচণ্ড গরমে কষ্টে থাকতে হয়।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত খনন না হওয়ায় নদীগুলো ভরাট হয়ে গেছে। এর ওপর অব্যবস্থাপনা ও দখলদারিত্ব সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করেছে। ফলে নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে বলেন, ‘নদী শুকিয়ে যাওয়া শুধু পরিবেশ নয়, স্থানীয় অর্থনীতি ও কৃষিনির্ভর জীবনকেও হুমকির মুখে ফেলছে। এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, ভুল নদীশাসন, দখল ও দূষণের কারণে নদীগুলো বিলীন হয়ে গেছে। অনুসন্ধান করলে এ সংখ্যা আরও বাড়বে।’

ঠাকুরগাঁও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম যাকারিয়া বলেন, ‘নদী রক্ষায় খনন অত্যন্ত জরুরি। আমরা ইতোমধ্যে খননের জন্য তালিকা তৈরি করেছি। পাশাপাশি দখলমুক্ত করতে অভিযানের পরিকল্পনা রয়েছে।’