বেহাল রেলপথ পরিদর্শনে ছয় রুটে ছয় দল গঠন

Passenger Voice    |    ১২:৫৬ পিএম, ২০২৫-০৯-২৭


বেহাল রেলপথ পরিদর্শনে ছয় রুটে ছয় দল গঠন

দেশের রেলপথের বেহাল দশা সরেজমিনে পরিদর্শন করতে রেলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ছয়টি রুটে ছয়টি আলাদা দল গঠন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। গত ২৭ আগস্ট রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এই ছয়টি কমিটি গঠন করে দেন। সরেজমিনে গিয়ে রেলওয়ের সেবার মান উন্নীত করতে মাঠপর্যায়ে রেলওয়ের সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়েও প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে এই ছয় কমিটিকে। 

সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কমিটিগুলোকে সরেজমিন প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও পরে সময় বাড়ানো হয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আশা করছেন, আগামী অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হবে। মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার অফিস আদেশে বলা হয়েছে, এই ছয়টি দলের কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা-এমঅ্যান্ডসিপি) পার্থ সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। 

বাংলাদেশ রেলওয়ের অধীনে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল রুটে রেলপথে (রেল ট্র্যাক) প্রায়ই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। বহু বছর আগে স্থাপিত এসব রেলপথ এখন আধুনিক লোকোমোটিভ, রেকের চাপ সামলাতে পারছে না। এ ছাড়া ট্রেনের ভার (এক্সেল লোড) নেওয়ার সক্ষমতাও নেই ট্র্যাকের বিভিন্ন স্থানে। এতে যাত্রাপথে প্রায়ই থমকে যাচ্ছে ট্রেন। এক্সেল লোড সামলাতে না পারায় বগি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনাও (ডি-রেইল) বাড়ছে। এ কারণে রেল ট্র্যাক পরিদর্শন জরুরি হয়ে পড়েছে।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার অফিস আদেশে জানা গেছে, এ ছয়টি রেল রুট হলো ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, ঢাকা-জামালপুর, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-খুলনা রুট। 

ঢাকা-রংপুর রুটে পরিদর্শন দলের প্রধান রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) মো. তবিবুর রহমান; ঢাকা-সিলেট রুটের প্রধান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) মো. হারুন-অর-রশিদ; ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের প্রধান উপসচিব (বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন) মো. জামাল হোসেন; ঢাকা-জামালপুর রুটে প্রধান উপসচিব মো. শফিউর রহমান (উন্নয়ন-২) শাখা; ঢাকা-রাজশাহী রুটে প্রধান উপসচিব (উন্নয়ন) মো. মনির হোসেন; ঢাকা-খুলনা রুটে প্রধান সিনিয়র সহকারী সচিব (প্রশাসন-৪) মো. নাজমুল হুদা। 

অনুসন্ধান শেষে ছয়টি দল প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর রেলপথ মন্ত্রণালয় কী কী পদক্ষেপ নেবে, তাও প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সেসব তথ্য জানা গেছে। 

তারা জানান, প্রতিবেদন পাওয়ার পরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন গন্তব্যে রেলওয়ে ট্র্যাকে 

পর্যাপ্ত নুড়ি পাথর (ব্যালাস্ট) এবং ভাঙা স্লিপার প্রতিস্থাপন করা হবে। দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার মধ্যপাড়া কঠিন শীলাখনি থেকে পাথর সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। পরে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে ট্র্যাকে স্থাপন করা হবে। এ লক্ষ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ে বাজেট প্রণয়ণ করবে। 

সরেজমিন প্রতিবেদন পাওয়ার পর ডিসেম্বরের মধ্যেই বিভিন্ন স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম উঁচু করা, প্ল্যাটফর্মের জায়গা আরও বাড়ানো, পুরোনো রেলওয়ে ব্রিজ সংস্কার বা নির্মাণকাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সময়ের মধ্যে করপোরেট স্যোশাল রেসপনসিবলিটির (সিএসআর) আওতায় রক্ষিত বা অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধক স্থাপন ও লোকবল নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে।

রেলপথ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পদ্মা রেলওয়ে লিংক প্রকল্পের অধীনে নির্মিত স্লিপার নির্মাণ কারখানা দ্রুত সচল করা হবে। এই কারখানা চালু করতে সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে দ্রুত চুক্তি স্বাক্ষর সম্পন্ন করতে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন রেলপথ উপদেষ্টা।

রেলযাত্রা আরামদায়ক করতেও এসেছে নতুন নির্দেশনা। ট্রেনের আসনে হেডরেস্ট (সিটের ওপরের কুশন, যা যাত্রীর মাথা ও ঘাড়কে আরাম ও সুরক্ষা দেয়) এবং জানালার পর্দা বদলাতেও ব্যবস্থা নেবে রেলওয়ে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এই পরিষেবায় স্পন্সর হিসেবে পেতে চায় মন্ত্রণালয়। 

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা ঢাকা-সিলেট রুটে (পূর্বাঞ্চল) মিটারগেজে ডাবল ট্র্যাক নির্মাণ সম্পন্ন করতে চান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ট্রেন এক লেনে (সিঙ্গেল ট্র্যাকে) চলাচল করে বলে সিলেট রুটে রেল পরিষেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। 

এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. জিয়াউল হক বলেন, ‘সিলেট রুটে আমরা ডাবল ট্র্যাক নির্মাণের পরিকল্পনা করছি। রেলওয়ে ডুয়েলগেজ ডাবল ট্র্যাক নির্মাণে বেশি গুরুত্ব দেয়। তবে সিলেট রুটে মিটারগেজ ডাবল ট্র্যাক করার কথা ভাবা হচ্ছে। কারণ ডুয়েলগেজ ডাবল ট্র্যাক নির্মাণ করতে গেলে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে, যা রেলওয়ের ধারণারও বাইরে।’ 

সিলেট রুটে ডাবল ট্র্যাক নির্মাণের জন্য রেলওয়ে নতুন প্রকল্পের কথা ভাবছে। এ প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি একজন প্রকল্প পরিচালকও নিয়োগ করা হবে দ্রুত। একটি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পের কাজ পেতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাজেটের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ পেতেও রেলওয়ে কর্মকর্তারা চেষ্টা করছেন। জানা গেছে, চীনা বিনিয়োগ পেতেই বেশি আগ্রহী তারা। 

তবে এর আগে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের রেলপথে যেসব উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে, তাতে মান ধরে রাখতে বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকাদারি কার্যক্রমে যথাযথ তদারকির নির্দেশনা এসেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ওই সভায়।

রেলওয়ের জায়গায় স্থাপিত অবৈধ বাজার বা স্থাপনা দ্রুত অপসারণের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনাও দিয়েছেন রেলপথ উপদেষ্টা। ক্ষেত্রবিশেষে রেলওয়ের জায়গায় বেষ্টনীও দেওয়া হতে পারে। 

রেলওয়েতে কোন কোন সেকশনে এখন টিকিট নিরীক্ষক (টিটিই) স্বল্পতা রয়েছে, সেটিও সরেজমিন প্রতিবেদনে উল্লেখ করার নির্দেশনা রয়েছে। টিকিট নিরীক্ষা কার্যক্রমে স্বেচ্ছাসেবী (ভলান্টারি সার্ভিস) নিয়োগ করা যায় কি না, সেটি নিয়েও ভাবছে মন্ত্রণালয়। তবে এ নিয়ে টিকিট নিরীক্ষকদের আপত্তির কথাও শোনা গেছে রেল ভবনে। 

বিনা টিকিটে রেলযাত্রার বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়কে ভাবতে হচ্ছে। বিনা টিকিটে ভ্রমণ করা যাত্রীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে রেলওয়ে। কোন কোন সেকশনে বিনা টিকিটের যাত্রীদের হার বেশি, সেটিও সরেজমিন দলকে উল্লেখ করতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর সেসব নির্দিষ্ট স্পটে অভিযান জোরদার করবে রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি)। বিনা টিকিটে ট্রেনের ভেতরে বা ছাদে ভ্রমণ করলে জরিমানা গুনতে হবে যাত্রীদের। সেসব যাত্রীর নাম ও জরিমানার তথ্য রেলওয়ের ফেসবুকে পেজে প্রচার করা হবে। 

রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, এখন থেকে রেলওয়ের কোনো স্থাপনা বা কোনো ট্রেন পরিদর্শন করতে হলে রেলপথ মন্ত্রণালয় বা রেলওয়ের কোনো কর্মকর্তা আগে থেকে কোনো নোটিশ জারি করতে পারবেন না। প্রয়োজন মনে করলে যেকোনো সময় তারা পরিদর্শনে যেতে পারবেন।