নতুন দুই মেট্রোরেল: নির্মাণ খরচ দ্বিগুণ, জাপানের বিকল্প খোঁজার চিন্তা

Passenger Voice    |    ০২:০০ পিএম, ২০২৫-০৯-২০


নতুন দুই মেট্রোরেল: নির্মাণ খরচ দ্বিগুণ, জাপানের বিকল্প খোঁজার চিন্তা

জাপানি ঠিকাদারের প্রস্তাব অনুযায়ী ঢাকায় বাস্তবায়নাধীন দুটি মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। এই ব্যয় সরকারের প্রাক্কলনের দ্বিগুণের বেশি। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার সহায়তায় প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম চলছে। তবে ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল সম্প্রতি জাপান সফরে গিয়ে জাইকার সঙ্গে আলোচনা করেছে। একই সঙ্গে প্রস্তাব পর্যালোচনা করে যৌক্তিক ব্যয় নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নির্ধারিত ব্যয়ে জাইকা কাজ করতে আগ্রহী না হলে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে অন্য কোনো দেশের প্রতিষ্ঠান দিয়ে নির্মাণকাজ শেষ করা হবে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মেট্রোরেলে ব্যয় কয়েক গুণ। আওয়ামী লীগ আমলে দর কষাকষির নামে কর্মকর্তারা দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। বিদেশি ঋণে বিপুল ব্যয়ে আরও দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দেশের মানুষকে এর বোঝা টানতে হবে। মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনাকারী ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির (ডিএমটিসিএল) একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। এটির আয় থেকে জাইকার ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

ঢাকায় ২০৩০ সালের মধ্যে মোট ছয়টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্যে চালু হওয়া লাইন-৬ (উত্তরা থেকে কমলাপুর) এর কাজ শেষ হওয়ার পথে। বাস্তবায়নাধীন দুটি মেট্রোরেল হচ্ছে এমআরটি লাইন-১ (কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর ও কুড়িল থেকে পূর্বাচল) এবং এমআরটি লাইন-৫ (সাভারের হেমায়েতপুর থেকে গাবতলী, মিরপুর, গুলশান হয়ে ভাটারা)। জাইকার কারিগরি সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই  শেষ করে সরকার ২০১৯ সালে প্রকল্প দুটির ব্যয় ধরেছিল প্রায় ৯৪ হাজার কোটি টাকা। সরকারের প্রাক্কলনে এমআরটি লাইন-১-এ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এমআরটি লাইন-৫-এর ব্যয় ধরা হয় ৪১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা।

দুটি মেট্রোরেলই পাতাল ও উড়ালপথের সমন্বয়ে বাস্তবায়ন করা হবে। এমআরটি-১ নির্মাণ ও ট্রেন কেনাসহ সব কাজ ১৪টি ভাগে (প্যাকেজে) বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। 

এর মধ্যে ডিপো উন্নয়নের কাজ চলমান। জাপানি ঠিকাদার এই কাজ করছে। ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর ও কুড়িল থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণে জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব অনুযায়ী ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৯৪ হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় তিন হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে।

এমআরটি লাইন-৫ (নর্দান রুট)-এর মোট দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটার। এর মধ্যে হেমায়েতপুর থেকে গাবতলী এবং নতুনবাজার থেকে ভাটারা পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার হবে উড়ালপথে। বাকিটা পাতালপথে হবে। স্টেশনের সংখ্যা ১৪। ইতোমধ্যে পাওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী এই প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রেও কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় তিন হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে।

মেট্রোরেলের ব্যয় বেশি হওয়ার কারণ জাইকার বিভিন্ন শর্ত এবং কম প্রতিযোগিতা। প্রকল্পের দরপত্রে ঠিকাদার হিসেবে জাপানি কোম্পানিগুলো অংশগ্রহণ করে। তারা চড়া দাম হাঁকায়। এতে দর কষাকষির সুযোগ কম থাকে। ডিএমটিসিএলে কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন অন্য দেশে জাপানি অর্থায়নের প্রকল্পের চেয়ে বাংলাদেশে ব্যয় বেশি। এই দুই প্রকল্পে ঋণের শর্ত ও দরপত্র প্রক্রিয়া ঠিক হয়েছিল গত সরকারের আমলে।

মেট্রোরেল প্রকল্পের খরচ কমানোর বিষয়ে জাইকার সঙ্গে আলোচনার জন্য গত ২৪ আগস্ট থেকে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল দুই সপ্তাহ টোকিও সফর করে। সফরকালে প্রতিনিধি দল জাইকার প্রেসিডেন্ট ছাড়াও জাপান সরকারের সঙ্গে বৈঠক করে মেট্রোরেল প্রকল্পের খরচ কমানো নিয়ে আলোচনা করেন। ব্যয় কামানোর জন্য পর্যালোচনার কথা বলা হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের প্রতি তাদের অস্থা না থাকলে যৌথভাবে পর্যালোচনার প্রস্তাবও দেওয়া হয়। প্রতিনিধি দলে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় (প্রতিমন্ত্রী) শেখ মইনউদ্দিন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সচিব মো. শাহ্‌রিয়ার কাদের ছিদ্দিকী, ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধি ছিলেন। 

এদিকে প্রতিনিধি দল দেশের ফেরার পর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে পর্যালোচনার কাজ শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে ডিএমটিসিএলের এমডি ফারুক আহমেদসহ সংশ্লিষ্ট খাত বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। কমিটি অন্যান্য দেশের মেট্রোরেল নির্মাণসহ দেশের পরিপার্শ্বিক বিষয় বিশ্লেষণ করে একটি যৌক্তিক ব্যয় প্রস্তাব করবে। নির্ধারিত এ ব্যয় জাইকার কাছে উস্থাপন করা হবে। তারা যদি এ ব্যয়ে কাজ করতে রাজি না হয় তাহলে বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশ বা সংস্থার অর্থায়নে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেবে সরকার। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, মেট্রোরেল নির্মাণে ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি শুরু থেকেই কারিগরি সহায়তা দিয়ে আসছে জাইকা। তাই সংস্থাটিকে বাদ দিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ কাজ বাস্তবায়ন খুব সহজ হবে না। এ জন্য কিছু আর্থিক ক্ষতি হলেও তা মেনে নিতে রাজি সরকার।

এ বিষয়ে সমকালের সঙ্গে আলাপকালে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এমনিতেই সরকারের ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এরপর এ দুই প্রকল্পে প্রথমে প্রাক্কলিত ব্যয় থেকে পরে অনেক বাড়ানো হয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ব্যয় হয়তো ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়তে পারে। কিন্তু বেড়েছে আরও অনেক বেশি। তাই এ ব্যয় কমানোর জন্য পুনরায় পর্যালোচনা করার জন্য জাইকাকে বলা হয়েছে।’ 

জাইকার পক্ষ থেকে কী বলা হয়েছে এ প্রশ্নে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ওরা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। তবে ব্যয় কমানোর প্রতিশ্রুতি দেয়নি। জানিয়েছে উচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে আমরা কমানোর জন্যই পর্যালোচনা করার কথা জানিয়েছি। কারণ আমাদের সামর্থ্যের মধ্যেই ব্যয় হতে হবে। তা না হলে এ ব্যয় ঝুঁকি তৈরি করবে। 

সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, পর্যালোচনার পর সরকার নির্ধারিত মূল্য জাইকার কাছে উপস্থাপন করা হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের কায়েকটি প্রস্তাব দেওয়া হবে। এরপর জাইকার পক্ষ থেকে যদি কোনো প্রস্তাব আসে সেটি নিয়েও পর্যালোচনা করা হবে। পর্যালোচনা কমিটি যদি মনে করে এত বেশি খরচে জাপানি প্রতিষ্ঠান দিয়ে মেট্রোরেল করানো ঠিক হবে না, তখন তাদের জানিয়ে দেওয়া হবে। অন্য কোনো দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, এত উচ্চমূল্যে মেট্রোরেল নির্মাণ সম্ভব নয় এমনটি জাইকাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন খরচ কমানোর জন্য পর্যালোচনার কাজ চলমান রয়েছে। জাপানের সঙ্গে আলোচনা করেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া  হবে।  

ঢাকার মেট্রোর খরচ বেশি
ডিএমটিসিএলের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে এ প্রকল্পগুলোর ব্যয় অন্যান্য দেশের সমমানের প্রকল্পগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। ডিএমটিসিএলের হিসাবে, ভারতে সাম্প্রতিককালে নেওয়া মেট্রোরেল প্রকল্পে খরচ ছিল প্রতি কিলোমিটারে ৫০০ কোটি টাকার কম। ভিয়েতনাম, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশে প্রস্তাবিত দরের চেয়ে কম টাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বলেন, ১ শতাংশের নমনীয় ঋণের নামে জাইকা অযৌক্তিকভাবে শর্ত আরোপ করে অপব্যবহার করে। তাদের শর্তের কারণে এসব কাজে জাপানি ছাড়া অন্য কোনো দেশের কোম্পানি দরপত্রে অংশ নিতে পারে না। ফলের ওই দেশের গুটিকয়েক কোম্পানি সিন্ডিকেট  করে বাড়তি দর হাঁকাই। বাধ্য হয়ে জাপানের ঠিকাদার, পরামর্শক ও পণ্য কিনতে হয় বেশি দামে। রক্ষণাবেক্ষণেও একই প্রযুক্তি ও পণ্য কিনতে বাড়তি খরচ হয়। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকারের  উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। 

তিনি আরও বলেন, প্রতি কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় বোধ হয় বিশ্ব রেকর্ড করবে। নিঃসন্দেহে এটি অতিমূল্যায়িত উন্নয়ন। এই উন্নয়ন শ্বেতহস্তী হবে। ভর্তুকি টানতে টানতে দেউলিয়া হতে হবে। অথচ জাইকা মেট্রোরেল নির্মাণে ভারত ও জাকার্তায় ঋণ দিয়েছে। কিন্তু ঢাকার মেট্রোরেলে ব্যয় কয়েক গুণ। কারণ সেসব দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঋণ নিয়ে দর কষাকষির সময় দেশের স্বার্থ রক্ষা করেন। আমাদের ইআরডির কর্মকর্তারা নমনীয় ঋণের নামে দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। সূত্র সমকাল