ট্রেন যাত্রীদের আশার আলো “ঐক্যবদ্ধ আশুগঞ্জ”

Passenger Voice    |    ০২:৪৫ পিএম, ২০২৫-০৬-১৬


ট্রেন যাত্রীদের আশার আলো “ঐক্যবদ্ধ আশুগঞ্জ”

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে স্টেশন মাস্টার সংকট ও আধুনিক সিগনালিং সিস্টেমের অভাবে ট্রেনে যাত্রী ওঠানামা এখন রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক সময় টিকিট কেটেও যাত্রীরা ট্রেনে উঠতে পারছেন না। স্টেশনে নেই সুপেয় পানি ও টয়লেটের ব্যবস্থা। অপরদিকে, শহীদ হাবিলদার আব্দুল হালিম রেলসেতু ও জিল্লুর রহমান রেলসেতুর নিরাপত্তা না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে এসব এলাকায় চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল।

এছাড়াও, টিকিট কালোবাজারি ও স্টেশন চত্বরে অসামাজিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ এই রেলস্টেশনটি যাত্রীদের জন্য এক আতঙ্কের স্থানে পরিণত হয়েছিল। অথচ আশুগঞ্জ একটি বন্দরনগরী, যার কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। তারপরও এখানে নেই কোনো স্থায়ী নিরাপত্তাকর্মী। রাতের বেলায় পুরো স্টেশনটি থেকে যায় অরক্ষিত, আর সেই সুযোগে অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে।

এই পরিস্থিতির পরিবর্তনে স্থানীয় কিছু তরুণ ও সচেতন নাগরিক ‘ঐক্যবদ্ধ আশুগঞ্জ’ নামে একটি সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যাত্রীসেবা ও স্টেশন ব্যবস্থার উন্নয়নের দাবিতে সংগঠনটি নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে যাত্রীদের কাছে এটি আশার আলো হয়ে উঠেছে।

সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঐক্যবদ্ধ আশুগঞ্জ প্রতিষ্ঠার পরপরই আশুগঞ্জ রেলস্টেশনকে ‘বি-গ্রেডে’ পুন:বহাল করার দাবিতে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করে তারা। এরপরও কোন কার্যকর পদক্ষেপ না আসায় সংগঠনের সদস্যরা যাত্রীদের স্বার্থে সরাসরি মাঠে নামে। প্রতিদিন ট্রেন গার্ডদের সহায়তায় টিকিটধারী যাত্রীদের ট্রেনে উঠার ব্যবস্থা করেন তারা।

সেইসাথে চুরি ও ছিনতাই রোধে শহীদ হাবিলদার আব্দুল হালিম রেলসেতু ও জিল্লুর রহমান রেলসেতু এলাকায় নিয়মিত টহল শুরু করে সংগঠনটি। এর ফলে দুই সেতু এলাকায় ছিনতাই বন্ধ হয়েছে। সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন সময়ে স্টেশন ও ট্রেন থেকে মোট ৭০ জন চোর ও ছিনতাইকারীকে ধরে পুলিশে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, আশুগঞ্জ তিতাস কাউন্টার থেকে কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করে দিয়েছে সংগঠনটি। বর্তমানে একজন যাত্রী লাইনে দাঁড়িয়ে ৫৫ টাকায় আসনসংবলিত টিকিট পাচ্ছেন, যা আগে কালোবাজারিদের মাধ্যমে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা করে কিনতে হত। এছাড়াও কাউন্টার থেকে টিকেট কাটতে গেলে একটি আসনসহ টিকেটের সাথে আরো একটি টিকেট অতিরিক্ত কিনতে হয়েছে। যা বর্মানে লাগছে না। ঐক্যবদ্ধ আশুগঞ্জ ঈদসহ বিভিন্ন সময় যাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে শরবত ও ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা করে। তীব্র গরমে প্রতিদিন ১ হাজারেরও বেশি পানির বোতল বিতরণ করেছে তারা। ট্রেনের যাত্রীদের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে সংগঠনটি দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা নিশ্চিত করেছে।

পাশাপাশি যাত্রীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন বগিতে নাম্বার দেয়া হয়েছে। স্টেশনে লাগানো হয়েছে ফ্রি ওয়াইফাই। স্টেশনের বিভিন্ন যায়গায় লাগানো হয়েছে অর্ধশতাধীক বিভিন্ন জাতের গাছের চারা। আগে বিশ্রামাগারগুলো বন্ধ থাকলেও এখন সার্বক্ষনিক খোলা থাকে। সেখানে যাত্রীদের বসার যায়গা করা হয়েছে। আশুগঞ্জ নেমপ্লেটগুলো নতুনভাবে লেখা হয়েছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে নিয়মিতভাবে। সতর্কতামূলক মাইকিং করা হচ্ছে যেন যাত্রীরা নিরাপদে ট্রেনে উঠতে ও নামতে পারে। পাশাপাশি টিকেটকালোবাজীদের দৌরাত্ম শুন্যের কৌঠায় নিয়ে এসেছে ঐক্যবদ্ধ আশুগঞ্জ। তিতাস কাউন্টার থেকেই সকল যাত্রীরা আসনসহ টিকেট পাচ্ছেন নির্ধারিত মূল্যে। এছাড়াও বিভিন্ন অপরাধীদের অন্তত ৭০ জনকে ধরে প্রশাসনের কাছে সোপর্দ করেছে ঐক্যবদ্ধ আশুগঞ্জ এর স্বেচ্ছাসেবীরা। অন্যদিকে ঈদের দিন শতাধিক স্টেশনে থাকা ছিন্নমূল মানুষের মাঝে খারার ও পানি বিতরণ করেছে তারা।

ঐক্যবদ্ধ আশুগঞ্জ নিয়ে উপকূল এক্সপ্রেসের যাত্রী সোলায়মান মিয়া বলেন, "তীব্র গরমে যখন যাত্রীদের অবস্থা খারাপ, তখন ঐক্যবদ্ধ আশুগঞ্জের স্বেচ্ছাসেবীরা ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা করে। এটা খুবই প্রশংসনীয় ও ফজিলতের কাজ।"

মহানগর এক্সপ্রেসের যাত্রী আমিরুল ইসলাম বলেন, "আগে রাতে এই স্টেশনে নামলে ভয় লাগত। এখন নিরাপদ বোধ করি, কারণ ঐক্যবদ্ধ আশুগঞ্জ পাশে আছে।"

তিতাস ট্রেনের যাত্রী নাসির মিয়া বলেন, ঐক্যবদ্ধ আশুগঞ্জের কারনে বর্তমানে লাইনে দাড়িয়ে ৫৫ টাকায় আসনসহ টিকেট পাওয়া যায়। আগে যা কল্পনাও করা যেতো না। আমি ধন্যবাদ জানাই এই সংগঠনের সকল স্বেচ্ছাসেবীদের।

ঐক্যবদ্ধ আশুগঞ্জের স্বেচ্ছাসেবী আলাউদ্দিন অমি বলেন, "আশুগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন এক সময় বি-গ্রেডে ছিল, কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই তা ডি-গ্রেডে নামিয়ে আনা হয়। এতে যাত্রীসেবা একেবারেই ব্যাহত হয়। সিগন্যালিং ব্যবস্থা ও স্টশন মাষ্টার না থাকায় ট্রেন চলাচল করে নিজেদের খেয়াল খুশিমতে। যার কারনে অনেক যাত্রী টিকেট কেটেও ট্রেনে উঠতে পারে না। আমরা স্টেশন পুনরায় বি-গ্রেডে উন্নীত করার দাবি জানাচ্ছি।"

তিনি আরও বলেন, "কালোবাজারি রোধ, জিআরপি ফাঁড়ি স্থাপন, সিসিটিভি ক্যামেরা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তাকর্মী, প্ল্যাটফর্ম সম্প্রসারণ, উন্নতমানের বিশ্রামাগার এবং নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরির দাবিতে আমরা এখনো কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু রেল মন্ত্রণালয় যদি আমাদের দাবি না মানে, তাহলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যাব।"

আশুগঞ্জ শহর শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি এবং সংগঠনের সিনিয়র স্বেচ্ছাসেবক মো. গোলাম হোসেন ইপতি বলেন, "আশুগঞ্জ হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম শিল্প ও বন্দর নগরী। এখানে আটটি কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার লোকজন চাকরির সুবাদে বসবাস করেন। এখানে চাহিদার তুলনায় ট্রেনের যাত্রাবিরতি ও আসন বরাদ্দ খুবই নগন্য। যার কারনে যাত্রীদের চলাচলে খুবই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। রাজস্ব আয় ভাল থাকার পরেও কয়েক বছর আগে কোন কারণ ছাড়াই স্টেশনটিকে বি গ্রেড থেকে ডি গ্রেডে নামিয়ে আনা হয়। যাত্রীসেবার মান চিন্তা করে আশুগঞ্জ রেলস্টেশনকে বি গ্রেডে পুন:বহাল ও বি গ্রেডের সকল সুযোগ সুবিধা বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় আমরা জোড়ালো আন্দোলন গড়ে তুলব ইনশাআল্লাহ।"

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আরিফ মুঠোফোনে বলেন, "টিকিট কেটে যাত্রী যদি ট্রেনে উঠতে না পারে, সেটা খুবই দুঃখজনক। আমরা গার্ডদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছি।"