শিরোনাম
আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে সব চেয়ারম্যান ছিলেন বারীর নিয়ন্ত্রণে
Passenger Voice | ১২:০৪ পিএম, ২০২৫-০৫-১৫
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. তাকজিল খলিফা কাজল। সদ্য সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হকের খুবই ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় বদলি বাণিজ্য, চাকরি বাণিজ্য ও আখাউড়া স্থলবন্দরের ব্যবসায় প্রভাব খাটিয়ে গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাহাড়। সেই তাকজিল খলিফার আস্থাভাজন ছিলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শক আব্দুল বারী । আব্দুল বারীর বড় ভাই সৌদি আরব প্রবাসী ইমদাদুল বারী ছিলেন সাবেক মেয়র তাকজিল খলিফার বন্ধু। সেই সুবাধে আখাউড়ায় খলিফার গড়ে তুলা সাম্রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেন বিআরটিএর আব্দুল বারী। তাকজিল খলিফার সাম্রাজ্য পরিচালনায় ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র জনতার আন্দোলন দমনের জন্য মোটাদাগে ঘুষের টাকা বিলাইতেন এই বিআরটিএর কর্মকর্তা।
আব্দুল বারী নিয়োগ পাওয়ারঃ ২০১২ সালের উপ-নির্বাচনে তাকজিল খলিফা প্রথমবারের মতো মেয়র নির্বাচিত হলে আব্দুল বারী হয়ে যায় বিআরটিএর অঘোষিত একটি সাম্রাজ্যের রাজা। বিআরটিএর চেয়ারম্যানদের সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে নিজের আখের গোছাতেন তিনি। প্রতিটি মেকানিক্যাল এসিস্ট্যান্ট পদের নিয়োগ চলাকালীন সময়ে আব্দুল বারীর জন্য একটি করে পদ খালি রাখতেন বিআরটিএর নিয়োগ বোর্ড। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে মেকানিক্যাল এসিস্টেন্ট নিয়োগ চলাকালীন সময়ে আওয়ামীলীগের ক্ষমতা ব্যবহার করে আব্দুল বারীর বড় ভাইয়ের ছেলে শফিকুল ইসলাম রাসেলকে বিআরটিএতে চাকরি প্রদান করেন। বর্তমানে রাসেল মোটরযান পরিদর্শক পদে পদোন্নতির সুপারিশ প্রাপ্ত হয়ে সুনামগঞ্জ সার্কেলে কর্মরত রয়েছেন।
২০২২ সালে বিআরটিএ পুনরায় মেকানিক্যাল এসিস্ট্যান্ট নিয়োগ পক্রিয়া শুরু করলে আবার আব্দুল বারীর জন্য একজনের কোটা খালী রাখা হয়। সেই বারেও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ক্ষমতা ব্যবহার করে তার আরেক ভাতিজা আসাদুজ্জামান পলাশকে নিয়োগ প্রদান করেন। বর্তমানে পলাশ বিআরটিএর মানিকগঞ্জ সার্কেলে কর্মরত আছেন। ২০২৩ সালের পরবর্তী নিয়োগে আব্দুল বারীর বড় বোনের ছেলে মো. সজিব উদ্দিনকে মেকানিক্যাল এসিস্টেন্ট পদে নিয়োগ দেয় বিআরটিএ। তিনিও বর্তমানে কুমিল্লা সার্কেলে কর্মরত আছেন। এইসব নিয়োগ প্রক্রিয়া গুলো আব্দুল বারী ও আখাউড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র তাকজিল খলিফা কাজল মিলেমিশে করতেন।
গতকাল ১৪ মে আব্দুল বারীর তিন ভাতিজা ও ভাগিনাদের সাথে প্যাসেঞ্জার ভয়েস যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে।
আব্দুল বারীর চাকরিতে সুপার পাওয়ারঃ ২০১২ সালে উপ-নির্বাচনে প্রথমবারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন তাকজিল খলিফা কাজল। পরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় মেয়র হয়ে বেপরোয়া হয়ে যান। দল-প্রশাসন সবই চলতো তার কথায়। পুরো আখাউড়ায় গড়ে তুলেছিলেন সাম্রাজ্য। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর নিরুদ্দেশ হয়েছেন সাবেক মেয়র কাজলও। কিন্তু এখনও বহাল তবিয়তে আব্দুল বারী। কাজল মেয়র হওয়ার পর থেকে বিআরটিএর বদলী বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন আব্দুল বারী। ২০১৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত এই মোটরযান পরিদর্শক ঢাকা মেট্রো-২ সার্কেলে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৫ সালের পর থেকে কুমিল্লা সার্কেলে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এই কর্মকর্তাকে ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর বিআরটিএ কুমিল্লা সার্কেল থেকে নং-৩৫.০৩.০০০০.০১.০১৯.০২২ (অংশ-১)/২০১৮-৪১১২ সংখ্যক স্বারক মূলে বিআরটিএ কুষ্টিয়া সার্কেলে বদলী করে কর্তৃপক্ষ। তবে পছন্দের সার্কেলে বদলী হতে না পেরে কব্জির জোর দেখিয়ে ২০২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিআরটিএ কুমিল্লা সার্কেলে মোটরযান পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করেছেন এই কর্মকর্তা।
অন্য দিকে ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর নং-৩৫.০৩.০০০০.০০১.১৯.০৭৮.২০-১৪৯২ স্বারক মূলে আব্দুল বারীর সিন্ডিকেট সদস্য তার পছন্দের মোটরযান পরিদর্শক রিয়াজুল ইসলামকে বিআরটিএ চাঁদপুর সার্কেল থেকে বিআরটিএ কুমিল্লা সার্কেলের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয় কর্তৃপক্ষ। আব্দুল বারী বিদায় নিয়ে চলে যান বিআরটিএ কুষ্টিয়া সার্কেলে। রিয়াজুল ইসলাম যেহেতু সহকারী পরিচালক (চঃ দাঃ) দায়িত্ব পাওয়ার সময় ছিল সেহেতু দুইজনে সিন্ডিকেট গড়ে কাজ করার সুবিধার্থে রিয়াজুল যেখানে দায়িত্ব পাবে সেখানে আব্দুল বারী মোটরযান পরিদর্শকের দায়িত্ব নিবে এমন পরিকল্পনা তৈরি করেন এই দুই কর্মকর্তা।
পরিকল্পনার ফাঁদে পা দিয়ে নীতিমালা লঙ্গন করে বিআরটিএ মোটরযান পরিদর্শক রিয়াজুল ইসলামকে বিআরটিএ কুমিল্লা সার্কেল থেকে সিলেট সার্কেলের বদলী করে বিআরটিএ প্রশাসন বিভাগ। সেখানেও আব্দুর বারীর ক্ষমতার ব্যবহার হয়। সিলেট সার্কেলে সেই সময়ে সহকারী পরিচালকের (ইঞ্জিঃ) দায়িত্ব পালন করতেন বর্তমান বিআরটিএ ঢাকা মেট্রো-২ সার্কেলের উপ-পরিচালক সানাউল হক। বিআরটিএ সিলেট সার্কেলের নানান অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ২০২০ সালের ০৯ এপ্রিল সিলেটে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়। তবে সকলের অনুরোধে পরিবহন মালিকরা ধর্মঘট স্থগিত করলেও শ্রমিক আন্দোলন এর চাপে একই মাসের ১২ এপ্রিল বিআরটিএর সদর কার্যালয়ের এক আদেশে সহকারী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার সানাউল হককে সিলেট সার্কেল থেকে মাগুরা সার্কেলে বদলি করা হয়। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রিয়াজুল ইসলাম দায়িত্ব পাওয়ার লিস্টে থাকায় আব্দুল বারী উপর মহলে তদবীর করে ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল নম্বর-৩৫.০৩.০০০০.০০১.১৯.১০৬.২০-৬৩১ নং আদেশ মূলে বিআরটিএ সিলেট ও সুনামগঞ্জ সার্কেলের সহকারী পরচিালক (ইঞ্জিঃ) চঃ দাঃ হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে দেন রিয়াজুল ইসলামকে ।
এরই মধ্যে ঘুষ বাণিজ্যের সাম্রাজ্য গড়তে রিয়াজুলের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মোটরযান পরিদর্শক আব্দুল বারীকে বিআরটিএ সিলেট সার্কেলে বদলী হতে পরামর্শ দেয়। পরামর্শ পেয়ে বিআরটিএর প্রশাসন বিভাগকে ম্যানেজ করে ২০ মাসের মাথায় ২০২২ সালের ১৮ মে নম্বর-৩৫.০৩.০০০০.০০১.১৯.১০৬.২০-৮০৭ নং স্বারক মূলে বিআরটিএ কুষ্টিয়া সার্কেল থেকে বিআরটিএ সিলেট সার্কেলে বদলী হয়ে আসেন আব্দুল বারী। বিআরটিএ প্রশাসন বিভাগ কর্মকর্তাদের বদলীর বিষয়ে নীতিমালার কথা মুখে বললেও প্রভাবশালী ও ঘুষ দুর্নীতিতে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ দালাল নিয়ন্ত্রক এই আব্দুল বারীদের বিষয়ে নীতিমালা মানেন না বলে মাঠ পর্যায়ের স্বচ্ছ কর্মকর্তাদের মাঝে ক্ষোভ রয়েছে। তবে এইসব বিষয়ে নজর দেয়ার জন্য বিআরটিএ প্রশাসন বিভাগের কেউ নেই বলে প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে জানান বিআরটিএর ডজন খানেক মোটরযান পরিদর্শক। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মুখে সাবেক ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর নিরুদ্দেশ হয়েছেন সাবেক মেয়র তাকজিল খলিফা কাজলও। তবে সিলেট সার্কেলে বহাল তবিয়তে থাকেন আব্দুল বারী। বিআরটিএর কর্মকর্তাদের অভিযোগ ২০১২ সালের পর থেকে কোন চেয়ারম্যান ক ক্যাটাগরির সার্কেলের বাহিরে অন্য সার্কেলে বদলী করার সাহস পায়নি। গত ৭ মে দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযান চলাকালীন সময়েও কৌশলে আব্দুল বারী সার্কেল অফিসে অনুপস্থিত ছিলেন।
ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে আব্দুল বারীর ঘুষ লেনদেনঃ ২০১৭ সালে বিআরটিএর উপ-পরিচালক(প্রশাসন) এর দায়িত্বে ছিলেন উপসচিব শাহ আব্দুল তারিক। তার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে ২০১৭ সালে মেকানিক্যাল এসিস্ট্যান্ট পদে যোগদান করা সামিউল ইসলাম গত ৮ বছর ধরে সিলেট সার্কেলের লাইসেন্স শাখায় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এই সামিউলকে দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স গ্রহণের জন্য পরীক্ষা দিতে আসা গ্রাহকদের কাছ থেকে লাইসেন্স পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেয়ার কথা বলে আড়াই হতে তিন হাজার টাকা ঘুষ আদায় করে থাকেন, প্রতিটি বোর্ডে গড়ে ৫ লাখ টাকা করে ঘুষ লেনদেন হলে মাসে প্রায় ১ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয় লাইসেন্স শাখায়। এই টাকা গুলো পরবর্তীতে নিজেদের মধ্যে ভাগভাটোয়ারা করে থাকেন তারা। আব্দুল বারী লাইসেন্স বোর্ডের সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করার ফলে এই কাজগুলো করা তার জন্য সহজ হয়ে যায়।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে মেকানিক্যাল এসিস্ট্যান্ট সামিউল ইসলাম প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমাকে বিআরটিএ প্রশাসন শাখার ৮ বছর ধরে একই সার্কেলে রেখেছে। আমি বেশ কয়েকবার দেশের যে কোন ‘ঘ’ সার্কেলে বদলী করার জন্য ডিপাটমেন্টকে বলেছি। তবুও আমাকে বদলী করা হয়নি। অনেকদিন একই সার্কেলে দায়িত্ব পালন করার কারণে আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ করে লোকজন।
মোটরযান পরিদর্শক আব্দুল বারীকে বারবার কল দিলেও তার মোবাইল ফোনে সংযোগ পাওয়া যায়নি।
সিলেট সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) আশরাফ সিদ্দিকি মান্নান প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, যদি ড্রাইভিং লাইসন্সে পরিক্ষার বোর্ড নিয়ে কোন অভিযোগ উঠে বা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ থাকে তাহলে বিআরটিএ, জেলা প্রশাসন, দুদক সহ সমন্নিতভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া যে কোন বোর্ডের পুনরায় ডিসিটিবি পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। সকলের সামনে পূর্বের রেজুলেশনে পাস করা পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা গ্রহণ করলে সেটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে। এছাড়া সামিউল ইসলাম গত ৮ বছর ধরে সিলেটে দায়িত্ব পালন করছেন বলে এই কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।
সিলেট বিভাগীয় উপপরিচালক (ইঞ্জিঃ) মো. ডালিম উদ্দীন প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, বিআরটিএর সিলেট সার্কেলে লাইসেন্স প্রদানে ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি কেউ লিখিত কোন অভিযোগ করেনি। আমার কাছে এমন কোন অভিযোগ আসলে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2019 - 2025 PassengerVoice | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ
Developed By Muktodhara Technology Limited.
পাবলিক মতামত