সড়ক উপদেষ্টার আত্মীয় পরিচয়ে গ্রাহককে টর্চার সেলে হকিস্টিক দিয়ে পেটাতেন বিআরটিএর দেলোয়ার

চুরির সিএনজির চ্যাসিস পাঞ্চ করে জাল কাগজ তৈরি, তথ্য গোপন রাখতে মালিকের ব্ল্যাংক চেক গ্রহণ

Passenger Voice    |    ১০:০০ এএম, ২০২৫-০৫-০৮


চুরির সিএনজির চ্যাসিস পাঞ্চ করে জাল কাগজ তৈরি, তথ্য গোপন রাখতে মালিকের ব্ল্যাংক চেক গ্রহণ

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ দেলোয়ার হোসাইন ২০১৪ সালে মেকানিক্যাল এসিস্ট্যোন্ট পদে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএতে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকে ঘুষ বাণিজ্য, অবৈধ টাকা আয়, বিলাসী জীবন সবই করতেন তিনি। সাম্প্রতিক বিভিন্ন পত্রিকায় এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ প্রকাশিত হলেও অদৃশ্য কারণে কোন দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে বিআরটিএর চেয়ারম্যান কোন ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। 

প্যাসেঞ্জার ভয়েস এর অনুসন্ধান বলছে, সিলেট -থ- ১১-২৫২২ নং গাড়িটি ২০১০ সালে কর্তৃপক্ষের সার্কেল অফিস পরিবর্তন করে গাড়িটি বিআরটিএর টাঙ্গাইল সার্কেল অফিসে অন্তর্ভুক্ত করে মালিকপক্ষ। ২০১১ সালের ১২ জুন সাউথইষ্ট ব্যাংকের টাঙ্গাইল শাখায় সরকারি ফি জমা প্রদান করে ১৪ জুন বিআরটিএর টাঙ্গাইল সার্কেলের তৎকালিন মোটরযান পরিদর্শক মো. রুকুনোজ্জামানের কাছ থেকে ফিটনেস সনদ গ্রহণ করেন। বিআরটিএর আইএস সফটওয়্যারের তথ্যানুযায়ী গাড়িটির  মালিক সিলেটের গোপালগঞ্জ এলাকার নওয়ায় দক্ষিণবাগ গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের পুত্র সানুর মিয়া। গাড়িটির সর্বশেষ ফিটনেস সনদের মেয়াদ শেষ হয় ২০১২ সালের ১৩ জুন। দীর্ঘ ১২ বছরের অধিক সময় এই গাড়ির কাগজপত্রের কোন হদিস পাওয়া যায়নি। গাড়িটিও কোথায় আছে কেউ জানেনা। বিষয়টি বিআরটিএ সিলেট সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক দেলোয়ার হোসাইনের নজরে আসলে প্রথমে তার বিশ্বস্ত দালাল দিয়ে একটি পুরাতন গাড়ি ক্রয় করে সেই গাড়ির চ্যাসিস খোদায় করে সিলেট -থ- ১১-২৫২২ নং গাড়ির চ্যাসিস বসানো হয়। পরবর্তীতে সিলেট আম্বরখানা গ্রামের সুরুজ আলীর পুত্র মো. নেসার উদ্দিন ফাহিম (১৯) নামের এক ব্যক্তিকে ব্যবহার করে ২০২৪ সালের ১লা ডিসেম্বর শাহী ঈদগাহ থেকে বন্দরবাজার কোর্ট পয়েন্টে যাওয়ার পথে গাড়িটির কাগজপত্র হারিয়ে গেছে মর্মে  সিলেট সদর (কোতয়ালী) থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করানো হয়। জিডি নং-১৬৯৮ তারিখ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪। পরবর্তীতে গাড়িটির কাগজ তৈরি করেন মোটরযান পরিদর্শক দেলোয়ার নিজে। ২০২৪ সালের ১লা এপ্রিল সিলেটের মার্কেন্টাইল ব্যাংকের শাখায় উক্ত ফাহিম এর মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে ১২ বছরের সব সরকারি ফি জমা করা হয়। 

প্যসেঞ্জার ভয়েসের প্রতিনিধি বিআরটিএর আইএস সফটওয়্যারেরে পাওয়া ফাহিমের নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাকে পরিচিত একটি লোক এই গাড়িটির কাগজ হারিয়ে গেছে মর্মে একটি থানায় জিডি করে দিতে বলে। আমি তার কথামতো জিডি করে দি। পরবর্তীতে সেই লোক আমার মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েছেন। আর আরকিছু জানিনা। পরবর্তীতে জালিয়াতির মাধ্যমে এই গাড়ির ২০২৪ সালের ১২ মে ফিটনেস সনদ ইস্যু করেন মোটরযান পরিদর্শক দেলোয়ার হোসাইন নিজে। 

তবে এখানে শেষ নয়, সিলেট-থ-১১-৩২৬০ নং গাড়িটি ২০০৩ সালের ১৮ মার্চ সিলেটের হাজী সিদ্দিক খানের পুত্র আব্দুল রহিম খানের নামে রেজিষ্ট্রেশন প্রদান করেন বিআরটিএর সিলেট সার্কেল।  গাড়িটি ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার বাসিকপুর গ্রামের মৃত মোকলেছুর রহমানের পুত্র বদিউল আলমের কাছে বিক্রি করেন আব্দুল রহিম খান। সাউথইস্ট ব্যাংক ফেনী শাখার তথ্যমতে ২০১৩ সালের ২৮ মার্চ বদিউল আলমের নামে মালিকানা হস্তান্তরের টাকা জমা হয়। মালিকানা পরিবর্তনের রিসিট নং- ১৫০৮২৪১১৬১৪৯৮। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিআরটিএ ফেনী সার্কেলে অথরিটি গ্রহণের জন্য সিটি ব্যাংকের ফেনী শাখায় Endorsement (Record Change) টাকা জমা করেন। ই-ট্যাকিং নং- ১৪০৯১০১১৯১৪৪৪। সেই থেকে সকল কাগজপত্রের অথরিটি হয়ে যায় বিআরটিএর ফেনী সার্কেল অফিস। এরপর ফেনী জেলা যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি (আরটিসি) কর্তৃক ফেনী জেলা এলাকায় চলাচলের জন্য রুট পারমিট ইস্যু করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ফেনী সার্কেলের দায়িত্বে থাকা তৎকালীন মোটরযান পরিদর্শক মো. আনোয়ার হোসাইন ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর, মোটরযান পরিদর্শক মাহবুব রাব্বানী তিন দফায় ২০১৬ সালের ২৪ নভেম্বর, ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর এবং ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারী ফিটনেস সনদ নবায়ন করেন। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ১লা জুলাই ফেনী সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক জমির উদ্দিন ফিটনেস সনদ ইস্যু করেন। এই গাড়িটিও অবৈধ ভাবে আইন লঙ্ঘন করে ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর ফিটনেস সনদ ইস্যু করেন সিলেটের এই দুর্নীতিবাজ মোটরযান পরিদর্শক দেলোয়ার হোসাইন। 

সূত্র বলছে চুরির সিএনজির চ্যাসিস খোদাই করে তৈরি করা এই গাড়ি গুলোর জাল কাগজ তৈরির তথ্যগুলো গোপন রাখতে মালিকদের কাছ থেকে ৩ টি গাড়ির বিপরীতে ১টি করে ব্ল্যাক চেক জমা নিতেন মোটরযান পরিদর্শক দেলোয়ার হোসাইন। গতকাল ৭ মে দুদকের অভিযানে দেলোয়ার হোসেনের কক্ষ থেকে ৫ টি ব্ল্যাংক চেক উদ্ধার করেছে দুদকের কর্মকর্তারা। এছাড়া অনেক গ্রাহকের দাবী জাল জালিয়াতির সকল তথ্য দেলোয়ার তার বাসায় সংরক্ষণ করে থাকে। বাসায় দুদকের অভিযান চালানো হলে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাবে। 

দেলোয়ারের টর্চার সেলঃ ২০২২ সালে মেকানিক্যাল এসিস্টেন্ট থেকে মোটরযান পরিদর্শক পদে বদলী হওয়ার পর থেকে তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেন। দেলোয়ারের সিন্ডিকেটের সদস্যদের নির্ধারিত ঘুষের টাকা কোন গ্রাহক প্রদান করতে রাজি না হলে তাকে টর্চার সেলে এনে বেধম পিটাতেন। গত ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় সিলেট সদরের খাদিম নগর দাসপাড়া গ্রামের মৃত ফজলু মিয়ার পুত্র জনৈক মো. রেদুওয়ান আলম রাজুকে রাত ১২ টা পর্যন্ত এই টর্চার সেলে বেঁধে হকিস্টিক দিয়ে বেধম পিটিয়েছেন মোটরযান পরিদর্শক দেলোয়ার হোসাইন। রাত ১২ টার দিকে রেদুওয়ানের আত্মীয় স্বজন খোঁজ পেয়ে তাকে উদ্ধার করে ওসমানি মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসেন । যার তথ্য হসপিটালের রেকর্ডে রয়েছে। বেপরোয়া এই মোটরযান পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেনের বাড়ী সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এর নিজ উপজেলায় হওয়ায় তিনি তার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে এইসব অপকর্ম করতেন। গতকাল দুদকের চলা অভিযানে সেই টর্চার সেলে নির্যাতন করা হকিস্টিক উদ্ধার করেছে দুদক কর্মকর্তারা। এছাড়াও এই কর্মকর্তার রয়েছে বেসরকারি পাসপোর্ট। সরকারী চাকুরিতে যোগদানের পূর্বে এই পাসপোর্ট ইস্যু করা হলেও চাকুরি চলাকালীন সময়ে বিআরটিএর অনুমোদন না নিয়ে সরকারি চাকুরির তথ্য গোপন রেখে পাসপোর্টটি নবায়ন করছেন। 

এই বিষয়ে জানতে বিআরটিএর সিলেট সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক দেলোয়ার হোসাইন প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমি বেসরকারী পাসপোর্ট ব্যবহার করি এটা সত্য। তবে আমি এই পাসপোর্ট ব্যবহার করে কখনো দেশের বাহিরে ভ্রমণ করিনি। সড়ক উপদেষ্টার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে টর্চার সেল চালানোর বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে রিদোয়ানকে পিটানোর বিষয়টি স্বীকার করেন। 

তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিআরটিএর ময়মনসিংহ সার্কেলের সহকারী পরিচালক ওয়াজেদ হোসাইন ও  মোটরযান পরিদর্শক আব্দুল খাবিরুর বিরুদ্ধে ঘুষের বিনিময়ে স্লিপার বাস নিবন্ধনের অভিযোগ উঠলেও অদৃশ্য কারণে কোন ধরণের ব্যবস্থা নেয় নি বিআরটিএ। শুধু এখানে শেষে নয় সাম্প্রতিক সময়ে বিআরটিএর মাদারীপুর সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক সামসুদ্দীন ও সহকারী পরিচালক মো. মামুনুর রশিদ এর দুর্নীতির বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মানববন্ধনসহ বিভিন্ন আন্দোলন হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি। সিলেট বিআরটিএর এই মোটরযান পরিদর্শকের বিরুদ্ধেও গত বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও অদৃশ্য কারণে কোন ধরণের ব্যবস্থা নিতে পারেনি বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. ইয়াছিন। 

আজ সিলেট বিআরটিএর টর্চার সেলে নির্যাতন ও ব্ল্যাংক চেক উদ্ধারের বিষয়ে বিআরটিএর পরিচালক (প্রশাসন) কামরুল ইসলাম চৌধুরী প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমরা বিষয়টি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখেছি। দুদক কর্তৃক হকিস্টিক ও ৫ টি ব্ল্যাক চেক উদ্ধার হয়েছে। এছাড়া এই মোটরযান পরিদর্শকের যদি বেসরকারী পাসপোর্ট ব্যবহার করে থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।