শিরোনাম
Passenger Voice | ০১:১৯ পিএম, ২০২৪-১১-২২
নিবন্ধনের সুযোগ নেই ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার। তারপরও অবাধে আমদানি ও উৎপাদন হয়েছে। সড়কে চলাচলের বৈধতা না থাকলেও জীবিকা ও কর্মসংস্থানের দিকে তাকিয়ে উচ্ছেদও করা হয়নি। মাঝেমধ্যে আদালত ও সরকার বন্ধের ঘোষণা দিলেও সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলো নিয়মের বাইরে গিয়ে চলাচলের অনুমোদন দিয়েছে। এতে যানজট ও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী হিসেবে চিহ্নিত তিন চাকার এ বাহনগুলো এখন গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক এতই বেড়েছে যে, এখন আর নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। শৃঙ্খলায় আনার নীতিমালাও তিন বছর ধরে ঝুলে আছে।
জীবিকা রক্ষার যুক্তিতে সড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত নছিমন, করিমন, আলমসাধু ও ভটভটির মতো দেশীয়ভাবে তৈরি যানবাহন এবং ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশাকেও নিবন্ধন দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে ২০২১ সালের নভেম্বরে খসড়া নীতিমালা করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এতে বলা হয়েছিল, কারিগরি মানোন্নয়নের শর্তে এলাকা ও সড়কভেদে এ ধরনের নির্দিষ্টসংখ্যক যানবাহন চলতে পারবে। সারাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইকের সংখ্যা কত– সেটা কেউ জানে না। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, সংখ্যাটি কমপক্ষে ১৫ লাখ অটোরিকশা ও অটোটেম্পোকে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) নিবন্ধন দিলেও নছিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটি, ইজিবাইক ও পাখি নামে পরিচিত ব্যাটারিচালিত রিকশা অবৈধ।
হাইকোর্ট শ্যালো মেশিনের ইঞ্জিনে নির্মিত নছিমন, করিমন, আলমসাধু বন্ধে ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি আদেশ দিয়েছেন। ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে ২২টি জাতীয় মহাসড়কে অটোরিকশাসহ এসব যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়।
রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোয় সাধারণ রিকশা চলাচলও নিষিদ্ধ। দুই সিটি করপোরেশন প্যাডেলচালিত প্রায় দুই লাখ ৩৩ হাজার রিকশা ও ভ্যানের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু কয়েক বছরে এসব রিকশায় ব্যাটারি বসানো হয়েছে। বছর দুয়েক ধরে বড় আকারের ‘হাইব্রিড’ ব্যাটারিচালিত রিকশা সড়কে চলছে। ঢাকায় ব্যাটারি রিকশা দুই লাখের বেশি বলে ধারণা করা হয়। গত ১৫ মে তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিআরটিএ সভা থেকে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ দেন। চালকদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ২০ মে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাটারিচালিত রিকশা অলিগলিতে চালানোর মৌখিক অনুমতি দেন।
গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর সড়কে পুলিশ না থাকায় মূল রাস্তায়ও দাপটে চলতে শুরু করে ইজিবাইক ও ব্যাটারি রিকশা। তবে কিছু দিন ধরে পুলিশ তৎপর হওয়ার পর এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এর পর মূল সড়কে দিনে ব্যাটারি রিকশা চলাচল অনেকটাই বন্ধ। গত মঙ্গলবার হাইকোর্ট রাজধানী থেকে তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারি রিকশা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন। এর প্রতিবাদে গতকাল আন্দোলনে নেমে রাজধানী অচল করে দেন চালকরা।
ব্যাটারি রিকশা ও ইজিবাইক নিয়ে সরকারের দ্বৈতনীতি এবং এক পা এগিয়ে দুই পা পেছানো চলছে বহু বছর ধরেই। ২০১৫ সালে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে এসব গাড়ি আমদানি বন্ধের প্রস্তাব উঠলেও কর্মসংস্থান রক্ষার যুক্তিতে জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের বিরোধিতায় তা অনুমোদন পায়নি। ২০১১ সালে ইজিবাইক আমদানি বন্ধে সরকার সিদ্ধান্ত নিলেও উৎপাদন ও আমদানি অব্যাহত থাকে।
প্রকৌশলীদের মতে, ইজিবাইক ও ব্যাটারির রিকশা কারিগরিভাবে সড়কের উপযোগী নয়। ব্রেক, স্টিয়ারিং ও সাসপেনশন মানসম্মত নয়। ফলে দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। সড়কে হতাহতের বড় অংশই এসব ছোট যানবাহনের যাত্রী। কিন্তু সাশ্রয়ী হওয়ায় স্থানীয়ভাবে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন এসব যানবাহনের ওপর নির্ভরশীল।
২০১৯ সালের জুনে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে ‘দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পে ছোট গাড়ি নিয়ন্ত্রণে সুপারিশ প্রণয়ন কমিটি’ করে বিআরটিএ। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ১২ সদস্যের এই কমিটি প্রতিবেদনে জানায়, সারাদেশে অটোরিকশাসহ কমপক্ষে ১৫ লাখ ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহন চলছে। এতে অন্তত ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ও জীবিকা হয়েছে। তাই সড়ক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আর্থসামাজিক নিরাপত্তা বিবেচনায় এসব যানবাহনকে অনুমতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন। স্থানীয়ভাবে নির্ভরশীলতার কারণে বারবার চেষ্টা করেও এসব গাড়ি বন্ধ করা যায়নি। অবৈধ এসব গাড়িকে চলার সুযোগ করে দিয়ে বছরে হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। বৈধতা দিলে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে, সরকার রাজস্ব পাবে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে ২০২৩ সালে ২৮ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে এসব যানবাহনের কারণে। সংগঠনটির পরিসংখ্যানে গত বছর ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে। ১ হাজার ৯৯টি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। ৮০১টি দুর্ঘটনায় নছিমন-করিমনের মতো যানবাহনের সংশ্লিষ্টতা ছিল। এ ছাড়া অটোরিকশা দুর্ঘটনা হয় ৫৯৯টি।
ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, অটোরিকশা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি খালেকুজ্জামান লিপন বলেছেন, মহাসড়কে নয়, সার্ভিস লেনে চলতে চালকদের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। তবে সব মহাসড়কেই সার্ভিস লেন নির্মাণ করতে হবে। সার্ভিস লেন থাকার পরও মূল সড়কে কোনো ইজিবাইক চললে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিতে পারে।
বাস-ট্রাক মালিক-শ্রমিকরা বলছেন, সড়ক-মহাসড়কে ব্যাটারি রিকশা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, ৮০ ভাগ বিশৃঙ্খলার কারণ ব্যাটারি রিকশা। মহাসড়কে বিভাজক স্থাপনের পর বাস ও ট্রাকের যত দুর্ঘটনা হয়েছে, তার বেশির ভাগ হয়েছে ধীরগতির গাড়ির কারণে। এগুলো বন্ধ না হলে বাসে দুর্ঘটনা চলতেই থাকবে।
গত সেপ্টেম্বরে যানজট নিরসনে প্রধান উপদেষ্টাকে ছয় দফা সুপারিশ করেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান। প্রথম সুপারিশ ছিল মূল সড়ক থেকে রিকশা বন্ধ করা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সড়ক নেটওয়ার্কে প্রবেশ করবে। ধীরগতির যানবাহন নিয়ে কীভাবে এগোবে! আজ না হয় কাল বন্ধ করতেই হবে।
তবে বিআরটিএ ও পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আইনশৃঙ্খলার বর্তমান নাজুক পরিস্থিতির কারণে ধীরেসুস্থে এগোতে হবে। তাই নীতিমালা করে বৈধতা দিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনাকে সমাধান মনে করছেন তারা।
‘থ্রিহুইলার ও সমজাতীয় মোটরযানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা’ কোন পর্যায়ে রয়েছে– প্রশ্নে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সাইফুল ইসলাম বলেন, চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নতুন উপদেষ্টা ও সচিব এসেছেন। তাদের অনুমোদন নিতে হবে। এর পর সরকারের অনুমোদন পেলেই চূড়ান্ত হবে।
তবে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, নীতিমালাটি পড়ে রয়েছে আওয়ামী লীগ আমল থেকেই। অন্তর্বর্তী সরকার তিন মাসের বেশি সময় দায়িত্বে থাকলেও অগ্রগতি নেই। নতুন সরকারের নির্দেশ আগের সরকারের সব কিছু খতিয়ে দেখে অনুমতি দিতে হবে। তাই কর্মকর্তারা কাজ বন্ধ রেখেছেন।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত 2019 - 2025 PassengerVoice | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ
Developed By Muktodhara Technology Limited.
পাবলিক মতামত