উচ্চশব্দে ডিউটি: কানে কম শোনা, হৃদরোগসহ নানা ঝুঁকি ট্রাফিকের

Passenger Voice    |    ০৬:০৮ পিএম, ২০২২-০৬-০৪


উচ্চশব্দে ডিউটি: কানে কম শোনা, হৃদরোগসহ নানা ঝুঁকি ট্রাফিকের

দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে ট্রাফিক বিভাগে চাকরি করেন বনানী জোনের পুলিশ পরিদর্শক (টিআই) কামরুল হাসান। ঢাকার শব্দদূষণের কারণে তিনি স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছেন না। রাস্তায় ডিউটি শেষ করে বাসায় গিয়ে মেজাজ থাকছে খিটখিটে। পরিবারের লোকরা মনে করেন তিনি হয়তো কোনো কারণে তাদের ওপর বিরক্ত। রাস্তায় ডিউটি করার কারণে পরিবারে গিয়েও তাকে উচ্চস্বরে কথা বলতে হচ্ছে। কারণ তিনি সারাদিন রাস্তায় ডিউটি করে মনে করছেন তিনি স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছেন। এমনকি পরিবারের সঙ্গে টেলিভিশন দেখতে গিয়েও ট্রাফিক সদস্য কামরুল হাসান সাউন্ড বাড়িয়ে দেখছেন, এতে পরিবারের অন্যদের সমস্যা হচ্ছে। ঘুমের মধ্যে অনেক সময় জেগে যাচ্ছেন। ট্রাফিক সদস্যরা স্বাভাবিক শব্দের চাইতে উচ্চস্বরে শব্দের সঙ্গে বেশি এডজাস্টেবল।

শুধু কামরুল হাসান নন। ১০ বছর ধরে ট্রাফিকে চাকরি করা মতিঝিল জোনের পুলিশ পরিদর্শক (টিআই) মো. মেজবা উদ্দীনও প্রায় একই সমস্যায় ভুগছেন।

শব্দদূষণে মূলত সব ট্রাফিক সদস্যের কানের সমস্যা হয়। এছাড়া মানসিকভাবে সব সময় ঝামেলায় থাকতে হয়। সড়কে ডিউটিরত ট্রাফিক সদস্যদের সব সময় স্বাভাবিকের চাইতে অতিরিক্ত ডেসিবেলের মধ্যে থাকতে হয়। এ কারণে স্বাভাবিক কাজকর্মে মন বসাতেও কঠিন হয়ে যায়। মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকে। লিখিত অভিযোগ না করলেও ট্রাফিকের বেশিরভাগ সদস্য মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন। 

তিনি জানান, শব্দদূষণের কারণে তাদের কানে সমস্যা হয়। দীর্ঘদিন সড়কে কাজ করতে গেলে পেটের নানাবিধ সমস্যাও হয়, মেজাজ খিটখিটে হয়, অতিরিক্ত শব্দের কারণে বাসায় গিয়েও স্বাভাবিক কথাবার্তা বলা সম্ভব হয় না। রাস্তাঘাটে কথা বলতে গেলে তাদের উচ্চস্বরে কথা বলতে হয়। এভাবে কথা বলতে বলতে অভ্যস্ত হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে গেলেও তারা সবসময় উচ্চস্বরে কথা বলছেন। তবে উচ্চস্বরে কথা নিজের অবচেতন মনেই বের হয়ে যাচ্ছে। শব্দদূষণের কারণে খাওয়া-দাওয়া ঠিকভাবে করা যায় না। খাওয়ায় অরুচি হয়। স্বাভাবিক শব্দের চাইতে বেশি ডেসিবলের শব্দ সবসময় ট্রাফিক সদস্যদের চারপাশে হচ্ছে। ঢাকার কোনো কোনো জায়গায় ৭০ থেকে ৮০ ডেসিবল অথবা তার চেয়েও অনেক বেশি অনেক জায়গায় হচ্ছে।

ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বলছেন, তাদের বেশিরভাগ সদস্যের প্রায় সময় প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করে, রাতে পর্যাপ্ত ঘুম হয় না, বাসায় গিয়ে বিনা কারণে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে খিটখিটে মেজাজ দেখান। কার শ্রবণশক্তি এবং স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হ্রাস, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, বুক ধড়ফড়, পেপটিক আলসার, উৎকণ্ঠা ও অমনোযোগী ভাব দেখা দিচ্ছে।

সম্প্রতি ভারতের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার ট্রাফিক পুলিশের ৮৪ ভাগ সদস্যই শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। আর শ্রবণশক্তি কমে গেছে ৬৫ শতাংশ সদস্যের। মূলত রাস্তায় দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করায় বায়ু ও শব্দদূষণের কারণেই এসব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ৩৮৪ জন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের ওপর পরিচালিত এ গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে দেশটির জার্নাল অব মেডিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল রিসার্চে।

গত বছর প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪০ শতাংশ ট্রাফিক সদস্য ঘুমের সমস্যায় ভোগেন। ঘুমের মধ্যে ৫৬ শতাংশ কানে সার্বক্ষণিক বিকট শব্দ শুনতে পান। ২৭ শতাংশ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

শব্দদূষণজনিত রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিন ৮০ জনের ওপর রোগী আমাদের দেখতে হচ্ছে। যারা কানের সমস্যায় আসছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ট্রাফিক সদস্য, গাড়িচালক ও কল সেন্টারে (কানে হেডফোন লাগিয়ে যাদের ডিউটি) কাজ করেন। এদের বয়স ২৫ থেকে ৪০ এর মধ্যে। যেসব রোগী আসেন তাদের বেশিরভাগ কানে কম শুনতে পাওয়া, কানে শব্দ হওয়া, মাথার মধ্যে ভোঁ ভোঁ শব্দ করা, মাথা ব্যথা, শারীরিক অবসাদ ও রাস্তা পার হতে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলার মতো ঘটনা রোগীরা শেয়ার করছেন। 

গত বছর ডেনমার্কের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মোটর গাড়ির হর্ন, সাইরেন ও অন্যান্য ট্রাফিক নয়েজের কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে ৬৫ ঊর্ধ্ব বয়স্ক লোকের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়ে ২৭ ভাগ পর্যন্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চশব্দের উৎসের কাছে দীর্ঘদিন কাজ করলে একজন মানুষের শ্রবণক্ষমতা স্থায়ীভাবে বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। রোগী, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জন্য শব্দদূষণ মারাত্মক ক্ষতির কারণ। শব্দদূষণের কারণে বিকলাঙ্গ শিশুও জন্মগ্রহণ করতে পারে।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন মতে শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষ শহরগুলোর প্রথম স্থানে রয়েছে ঢাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবাসিক এলাকার জন্য অনুমোদনযোগ্য শব্দের মাত্রা ৫৫ ডিবি (ডেসিবেল) এবং বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডিবি। সেখানে ঢাকায় শব্দের মাত্রা ১১৯ ডিবি এবং রাজশাহীতে ১০৩ ডিবি পাওয়া গেছে।

 তিন বছর বা তার কম বয়সী শিশু যদি খুব কাছ থেকে ১০০ ডেসিবেল শব্দ শোনে তাহলে সে শিশুটি চিরতরে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন অনেক স্কুলগামী শিশু শ্রবণশক্তি হারাতে বসেছে। উচ্চশব্দ শুধু শ্রবণশক্তিই নষ্ট করে না সৃষ্টি করে নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা। এমনকি মানসিক বিকাশের জন্যও এটি ক্ষতিকর। আমাদের দেশে হর্ন না বাজিয়ে গাড়ি চালানোর কথা-চিন্তাই করা যায় না। মাঝে মাঝে কানের কাছে এমন বিকট শব্দে হর্ন বাজানো হয় যে আঁতকে উঠতে হয়। 

শব্দ কী?

কোনো বস্তু যদি প্রতি সেকেন্ডে ২০ বারের বেশি কিংবা ২০ হাজার বারের কম কম্পিত হয় তাহলে শব্দ সৃষ্টি হয়। বস্তুর কম্পনের ফলে পরিবৃত বাতাসের যে পর্যায়ক্রমিক ঘনীভবন (Compression) ও তনুভবন (Rarefaction) ঘটে, তা চতুর্দিকে বিস্তৃত হয়ে যে তরঙ্গ গতির সৃষ্টি হয়, তাকে শব্দ তরঙ্গ বলে। এ শব্দ তরঙ্গ কানের পর্দায় আঘাত করলে ‘শব্দ’ হিসেবে তা অনুভূত হয়।

শব্দের ধরন

মাত্রা অনুযায়ী শব্দ তিন ধরনের হয়। শব্দের তীব্রতা (কর্কশ বা কোমল), তীক্ষ্ণতা (উঁচু বা নিচু) এবং স্বর (শব্দের বিশিষ্টতা)। শব্দের তীব্রতা শব্দ তরঙ্গের দৈর্ঘ্য বা বিস্তারের ওপর নির্ভর করে। শব্দ তরঙ্গের বিস্তার সমান হলে সেই শব্দ শ্রুতিমধুর হয়। শব্দ তরঙ্গের বিস্তার ও শ্রুতির পার্থক্যে শব্দ কর্কশ হয়। কর্কশ শব্দের সঙ্গে আমাদের কান ‘অপরিচিত’হলে শব্দ অসহ্য লাগে। শব্দের প্রভাবে জীবের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয় বলে একে ‘শব্দদূষণ' বলে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, মানুষের শব্দ গ্রহণের স্বাভাবিক মাত্রা ৪০-৫০ ডেসিবল। পরিবেশ অধিদপ্তরের ২০১৭ সালের জরিপে দেখা যায়, দেশের বিভাগীয় শহরগুলোয় শব্দের মানমাত্রা ১৩০ ডেসিবল ছাড়িয়ে গেছে, যা স্বাভাবিক মাত্রার চাইতে আড়াই থেকে তিনগুণ বেশি।

শব্দের সহনশীলতা কিংবা অসহনীয়তার মাত্রা পরিমাপের একক হচ্ছে ডেসিবল। মানুষের জন্য শব্দের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ৪৫ ডেসিবেল। পারিবারিক বা অফিসের স্বাভাবিক কাজকর্ম ও কথাবার্তা এই সহনীয় মাত্রার মধ্যে থাকে। ৪৫ ডেসিবেলের চেয়ে বেশি মাত্রার শব্দ, শব্দদূষণ হিসেবে বিবেচিত যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। শব্দের মাত্রা ৭০ ডেসিবেল অতিক্রম করলে তা মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

একটি ব্যস্ত সড়কে সাধারণত ৭০ কিংবা ৮০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ তৈরি হয়। তুলনামূলকভাবে একটি ঘাস কাটার যন্ত্র শব্দ তৈরি করে ৯০ কিংবা ১০০ ডেসিবেল। এছাড়া একটি জেট বিমান অবতরণকালে ১২০ ডেসিবেল শব্দ উৎপন্ন হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, তিন বছর বা তার কম বয়সী শিশু যদি খুব কাছ থেকে ১০০ ডেসিবেল শব্দ শোনে তাহলে সে শিশুটি চিরতরে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন অনেক স্কুলগামী শিশু শ্রবণশক্তি হারাতে বসেছে। উচ্চশব্দ শুধু শ্রবণশক্তিই নষ্ট করে না সৃষ্টি করে নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা। এমনকি মানসিক বিকাশের জন্যও এটি ক্ষতিকর। আমাদের দেশে হর্ন না বাজিয়ে গাড়ি চালানোর কথা চিন্তাই করা যায় না। মাঝে মাঝে কানের কাছে এমন বিকট শব্দে হর্ন বাজানো হয় যে আঁতকে উঠতে হয়। রাস্তাঘাটে যখন তখন, যত্রতত্র যেভাবে হর্ন বাজানো হয়, তা সভ্যতার প্রতীক হতে পারে না।

তারা আরও বলেন, ঢাকা হচ্ছে বিশ্বের একটি অন্যতম জনবহুল ও অপরিকল্পিত মহানগর। রাস্তায় অযথা গাড়ির হর্ন বাজিয়ে, মাইক ও লাউড স্পিকার দিয়ে পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে শব্দদূষণ করে না। উন্নত দেশগুলো হাজার লোকের সমাবেশে উচ্চশব্দের মাইক ব্যবহার না করে মাউথ স্পিকারের মাধ্যমে বক্তৃতা দেয়। মিছিলে উচ্চকণ্ঠে স্লোগান দিয়ে শব্দদূষণ না করে প্ল্যাকার্ড বহন করা হয়। বাস স্টেশন এমনভাবে তৈরি, আশপাশে শব্দদূষণের কোনো প্রভাব পড়ে না।

কয়েক বছর ধরে ঢাকা শহরের প্রায় সব ব্যস্ত এলাকায়ই শব্দ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। ঢাকা ছাড়াও অন্যান্য জেলা শহরের শব্দদূষণের উৎস বাড়ছে। তবে শব্দের উৎসগুলো স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভিন্ন হয়। সাধারণত যানবাহন চলাচলের শব্দ (হর্ন, ইঞ্জিন, চাকার ঘর্ষণ ও কম্পনের শব্দ), রেলগাড়ির শব্দ, বিমান ওঠানামার শব্দ, নির্মাণকাজ যেমন- ইট ও পাথর ভাঙা মেশিন এবং টাইলস কাটার মেশিন থেকে শব্দ, ভবন ভাঙার শব্দ, কলকারখানার শব্দ, জেনারেটরের শব্দ, সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের মাইকিংসহ ইত্যাদি উৎস থেকে শব্দ উৎপন্ন হয়। শহর এলাকায় শব্দদূষণের প্রভাব গ্রামাঞ্চল থেকে তুলনামূলকভাবে অনেকখানি বেশি। শুধু ঘরের বাইরে, রাস্তায়, কর্মস্থলে নয়, শব্দদূষণ ঘরের ভেতর আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন- ফুড ব্লেন্ডার, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, প্রেসার কুকার ইত্যাদি থেকেও উচ্চ শব্দ উৎপন্ন হচ্ছে।

২০০৬ সালের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী, নীরব এলাকায় দিনের বেলায় শব্দের মাত্রা থাকবে ৫০ ডেসিবেল এবং রাতের বেলা ৪০ ডেসিবেল। ওই বিধিমালার ধারা ৮ (২) এ অনুযায়ী, নীরব এলাকায় নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে হর্ন বাজালে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ওই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে প্রথম অপরাধের জন্য কমপক্ষে এক মাস কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। পরবর্তী অপরাধের জন্য কমপক্ষে ছয় মাস কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের বাসা থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুসন্তান নওরিন নুশাকে নিয়ে রিকশায় স্কুলে নিয়মিত যাতায়াত করেন মেহবুবা আক্তার মিহি। তিনি জানান, সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় গাড়ির অতিরিক্ত শব্দের কারণে তার ছোট্ট শিশু মাঝে মাঝে আঁতকে ওঠেন, মাঝে মাঝে বিরক্তবোধ করে হাতের আঙুল দুই কানের মধ্যে দিয়ে রাখে। ঢাকায় এতো বেশি গাড়ির হর্নের আওয়াজ যে একজন রিকশা বা পথচারীদের জন্য খুবই দুরূহ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, আমার বাচ্চা মাঝে মাঝেই বলে, আম্মু আমাদের একটা যদি গাড়ি থাকতো তাহলে আমাদের কানে এতো বেশি জোরে হর্নের আওয়াজ আসতো না, উল্টো আমাদের গাড়ির হর্ন দিয়ে অন্যদের কানে আওয়াজ দিতাম।

মোহাম্মদপুর জোনের সার্জেন্ট তোছাদ্দেক আলী বলেন, চাকরির আগে আমাদের কানে স্বাভাবিক যে শ্রবণশক্তি ছিল চাকরির পর তা অনেকাংশে কমে যায়। সড়কে ডিউটি করতে গেলে অনেক উচ্চস্বরে কথা বলতে হয়। অনেক সময় জোরে হর্ন দিলেও শুনতে পাচ্ছে না অনেকেই। রাস্তায় থাকলে মোবাইলে কথা বলতে গেলে লাউড স্পিকারে কথা বলতে হয়।

রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে কানের সমস্যায় আসা ট্রাফিকের কনস্টেবল আহসান হাবীব বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কানের সমস্যায় ভুগছি। অনেকদিন হলো ডাক্তার দেখাচ্ছি। ওষুধ খেলে কমে আর বন্ধ করলে আবার বাড়ে। টানা ৮ ঘণ্টা রাস্তায় ডিউটির কারণে অতিরিক্ত শব্দে কানে সমস্যা হয়েছে। এখন ডিউটি করতে গেলে অনেক সময় অন্য মনষ্ক হয়ে পড়ছি। বাসায় গেলে খিটখিটে মেজাজ থাকে। রাতে ভালো ঘুম হয় না। ডাক্তার বলেছেন পরিমিত বিশ্রাম নেওয়ার জন্য।

গুলশান ট্রাফিক বিভাগের মহাখালী জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) মো. আশফাক আহমেদ বলেন, সড়কে অতিরিক্ত শব্দের কারণে ট্রাফিক সদস্যরা কানের সমস্যায় ভুগছেন। ৮ ঘণ্টা ডিউটির পরে অনেকের মাথা ব্যথা ও রাতে পর্যাপ্ত ঘুম হয় না, জ্বর ও ক্ষুদামন্দার মতো সমস্যা দেখা যায়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে একটি জরিপ করা হয়, সেখানে দেখা যায় প্রায় ৬৫ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশের কানে সমস্যা। এছাড়া সড়কে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পানি ঠিক মতো পান না ও পর্যাপ্ত টয়লেট ব্যবস্থা না থাকার কারণে কিডনি সমস্যাও হচ্ছে তাদের।

অন্য লেনের সিগন্যাল না বন্ধ করা পর্যন্ত আরেক লেনের সিগন্যাল ছাড়ায় কোনো উপায় আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে থাকে না। একজন চালক দেখছেন তার সামনে সিগন্যাল তবুও তিনি অনবরত হর্ন বাজাতেই থাকেন। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ হাইড্রোলিক হর্নের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। কোনো গাড়িতে যদি হাইড্রোলিক হর্ন পাওয়া যায় তখন সেটি জব্দ করা হয় এবং ওই গাড়ির বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। হাইড্রোলিক হর্ন লোকাল মার্কেটে যারা আমদানি করছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে ডিএমপির ক্রাইম বিভাগ দোকান থেকে হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করে নিচ্ছে। ফলে দোকানে যদি হাইড্রোলিক হর্ন না পাওয়া যায় তাহলে গাড়িতে কেউ আর ব্যবহার করবে না। সর্বোপরি আমরা সবাই সচেতন নাহলে শব্দদূষণ রোধ করা সম্ভব নয়।

উত্তরা ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) বদরুল হাসান বলেন, শব্দদূষণে মূলত সব ট্রাফিক সদস্যের কানে সমস্যা হয়। এছাড়া মানসিকভাবে সব সময় ঝামেলায় থাকতে হয়। সড়কে ডিউটিরত ট্রাফিক সদস্যদের সব সময় স্বাভাবিকের চাইতে অতিরিক্ত ডেসিবেলের মধ্যে থাকতে হয়। এ কারণে স্বাভাবিক কাজকর্মে মন বসাতেও কঠিন হয়ে যায়। মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকে। লিখিতি অভিযোগ না করলেও ট্রাফিকের বেশিরভাগ সদস্য মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছু ট্রাফিকের একজন কনস্টেবল বলেন, রাস্তায় দীর্ঘদিন ধরে ডিউটি করার কারণে অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজও এখন কানে আসে। বেশিরভাগ গাড়িতে থাকা চালক বিনা কারণে হর্ন দেয়। কেউ সিগন্যাল ছাড়লেও দেয় সিগন্যাল না ছাড়লেও হর্ন দিতেই থাকে। অতিরিক্ত গরম আর হর্নের শব্দে মাঝে মাঝে শরীরে জ্বালাপোড়া করে। মনে হয় যারা হর্ন দিচ্ছেন তাদেরকে যেয়ে পেটাই।

ট্রাফিক মোহাম্মদপুর জোনের আসাদগেট পুলিশ বক্সের সার্জেন্ট ইসমত তারা বলেন, প্রতিনিয়ত অতিরিক্ত শব্দের কারণে আমরা যারা সড়কে ডিউটি করি তাদেরকে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়। বিশেষ করে রাতে ঘুম ভালো হয় না। ঘরে বাচ্চারা কান্নাকাটি করলে তাদের কান্না অনেক সময় শুনতে পাই না। যারা হর্ন দিচ্ছেন তারা অনেকটা অকারণেই হর্ন বাজাচ্ছেন। তবে এসব সমস্যা মাথায় রেখেই ট্রাফিকে আসা।

রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের নাক-কান-গলা রোগের চিকিৎসক ডা. সৈয়দা রুবাইয়া কিবরিয়া বলেন, শব্দদূষণজনিত রোগী বাড়ছে। প্রতিদিন ৮০ জনের ওপর রোগী আমাদের দেখতে হচ্ছে। যারা কানের সমস্যায় আসছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ট্রাফিক সদস্য, গাড়িচালক ও কল সেন্টারে (কানে হেডফোন লাগিয়ে যাদের ডিউটি) কাজ করেন। এদের বয়স ২৫ থেকে ৪০ এর মধ্যে। যেসব রোগী আসেন তাদের বেশিরভাগ কানে কম শুনতে পাওয়া, কানে শব্দ হওয়া, মাথার মধ্যে ভোঁ ভোঁ শব্দ করা, মাথা ব্যথা, শারীরিক অবসাদ ও রাস্তা পার হতে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলার মতো ঘটনা রোগীরা শেয়ার করছেন।

পুলিশ হাসপাতালের এই চিকিৎসক আরও বলেন, বিভিন্ন মাত্রার শব্দ ভিন্ন ভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। যেমন- ৬৫ ডেসিবেলের ওপর শব্দমাত্রায় হৃদরোগ; ৯০ ডেসিবেলের ওপর শব্দমাত্রায় আলসার, শ্রবণে ব্যাঘাত ও স্নায়ুতন্ত্রের পরিবর্তন; ১২০ ডেসিবেলের ওপর শব্দমাত্রায় শ্রবণযন্ত্রে ব্যথা এবং স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি লোপ পেতে পারে। তবে সবার ক্ষেত্রে একইরকম বা লক্ষণ দেখা যায় না। অনেক সময় কম ডেসিবল যদি দীর্ঘ সময় সহ্য করতে হয় তাহলে সেখান থেকেও সমস্যা হতে পারে।

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) পরিচালক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, আমরা সবাই শব্দদূষণের উৎসগুলো কি কি তা জানি এবং কোন এলাকায় কেমন শব্দদূষণ তাও জানি। এখন উৎসগুলো একটি একটি করে কমিয়ে আনা গেলে শব্দদূষণ কমে যাবে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি জরিপ ছিল শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত অংশীদারত্বমূলক প্রকল্প। সেখানে সারাদেশে শব্দদূষণের উৎস পরিমাপ করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ শব্দদূষণের কারণ হলো গাড়ির হর্ন। শব্দদূষণের প্রধান কয়েকটি কারণের মধ্যে গাড়ি, নির্মাণ সামগ্রী থেকে শব্দদূষণ ও সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে শব্দদূষণ।

তিনি বলেন, গাড়ির যে শব্দদূষণ হয় তা মূলত হাইড্রোলিক হর্ন থেকে আসে। বাংলাদেশে যদিও হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ হয়েছে অনেক আগেই। এরপরও ঢাকা শহরে ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ গাড়িতে নিষিদ্ধ হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহৃত হয়। আমরা যদি হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধ নিশ্চিত করতে পারি তাহলে একটি বড় অংশ শব্দদূষণ কমে যাবে। মোটরসাইকেলে যে হর্ন ব্যবহার করা হয় অনুমোদিত মাত্রার চাইতে সবগুলোই বেশি। সারাদেশে ২০ লাখের বেশি মোটরসাইকেল চলছে। মোটরসাইকেলগুলো দ্রুত চলার জন্য প্রায় সব সময়ই হর্ন দিচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য গাড়ি চালকরাও হর্ন দেওয়াকে খারাপ কিছু মনে করে না। এ অভ্যাসটা সবাইকে পরিহার করতে হবে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো এখনো শব্দদূষণ বিধিমালা ২০০৬ এর আওতামুক্ত। ওয়াজ মাহফিল ও বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো এখনো আওতামুক্ত। এগুলো আইনের আওতায় আনতে হবে। সর্বোপরি সাধারণ মানুষের সচেতন হতে হবে শব্দদূষণের বিরুদ্ধে।

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার আরও বলেন, ট্রাফিক পুলিশরা প্রায় সব সময়ই উচ্চ শব্দে কথা বলে। তারা মনে করে অন্যরা কম শুনতে পাচ্ছে এ কারণে তারা উচ্চশব্দে কথা বলছে। পরিবারের লোকেরা স্বাভাবিক শব্দে কথা বললে পুলিশ ট্রাফিক সদস্য তা শুনতে পায় না। এ কারণে পারিবারিকভাবে যোগাযোগ ব্যাহত হয়। ২০১৮-১৯ সালে আমরা একটি জরিপ করেছিলাম। সেখানে দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের প্রায় ১২ শতাংশ কানে শুনতে পায় না। ৩০ শতাংশ সদস্য কোনো না কোনোভাবে শব্দদূষণের ক্ষতিকর দিকগুলো থেকে আক্রান্ত। তারা মানসিকভাবে প্রায় সময় প্রেসারে থাকেন। তাদের মাথা ব্যথা ও বমি বমি ভাব হয়।

সূত্র:  জাগো নিউজ