গোড়াতে গলদ, রুট পারমিট নিয়ে গণপরিবহণে বিশৃঙ্খলা

Passenger Voice    |    ০১:৩৩ পিএম, ২০২২-০১-২১


গোড়াতে গলদ, রুট পারমিট নিয়ে গণপরিবহণে বিশৃঙ্খলা

রাজধানীতে গণপরিবহণে বিশৃঙ্খলা দূর করতে বাস রুট রেশনালাইজেশনের অংশ হিসেবে ঢাকা নগর পরিবহণ চালু করা হলেও তাতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য মিলবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছে। গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এ উদ্যোগের গোড়াতে নানা গলদ রয়ে গেছে। তা সংশোধন না করে এলোমেলো পদক্ষেপ নেওয়া হলে গণপরিবহণে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, রুট রেশনালাইজেশনের সুফল পেতে হলে নগর পরিবহণ ব্যবস্থায় রুট পারমিটবিহীন বাস-মিনিবাস চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। তা না হলে বাস মালিকরা এ পদ্ধতিতে গাড়ি পরিচালনা করতে অনীহা প্রকাশ করবে। এছাড়া রুট রেশনালাইজেশনের জন্য টার্মিনাল নির্মাণের জমি ও বাস স্টপেজের জায়গা চিহ্নিত করার মতো মৌলিক কাজ সম্পন্ন করা জরুরি। অথচ গত পাঁচ বছরেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা শেষ করতে পারেনি।
 
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে বর্তমানে ২৯১টি রুটে ৫/৬ হাজার বাস-মিনিবাস চলাচল করে। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৪৬টি বাসের রুট পারমিট নেই। এসব পরিবহণ মালিকরা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তাদের খেয়াল খুশিমত বাস পরিচালনা করছেন। রুট পারমিটবিহীন এই বিপুলসংখ্যক বাসের কারণেই মূলত গণপরিবহণ সেক্টরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ গত রোববার থেকে পরীক্ষামূলকভাবে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর টু নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর রুটে রেশনালাইজেশন পদ্ধতিতে বাস চলাচল শুরু করা হলেও এ পথে চলাচলকারী পারমিটবিহীন বাস-মিনিবাস বন্ধ করা হয়নি। ফলে রেশনালাইজেশন পদ্ধতিতে যেসব বাস চলাচল করছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ নিয়ে মালিক-শ্রমিকরা এরই মধ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বাসমালিক জানান, রুটে পারমিটবিহীন বাস চলাচল দ্রুত বন্ধ করা না হলে তিনি রেশনালাইজেশন পদ্ধতিতে গাড়ি চালাবেন না। তার ভাষ্য, ২০১৯ সালের পর থেকে ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর রুটে চলাচলকারী বিপুলসংখ্যক বাসের রুট পারমিট নেই। এসব বাস চলতে দেওয়া হবে না বলে রুট রেশনালাইজেশন কমিটি প্রতিশ্রম্নতি দিলেও তা এখন বন্ধ করা হয়নি। কবে নাগাদ এ ব্যাপারে অভিযান পরিচালনা করা হবে তা-ও অস্পষ্ট। তবে এ বিষয়ে রেশনালাইজেশন কমিটির বক্তব্য, দুই মাসের মধ্যে ঢাকা নগর পরিবহণের ১০০টি বাসের বাইরে অন্য কোনো বাস এই রুটে চলবে না। তবে দিন-তারিখ ঠিক করে তারা অভিযান চালাবেন না। কারণ অভিযানের আগাম খবর পেলে রুট পারমিটবিহীন গাড়ির মালিকরা তাদের বাস রাস্তায় নামান না। 

এদিকে রুট পারমিটবিহীন একাধিক গাড়ির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাড়ির রুট পারমিট করার ব্যাপারে তাদের অনাগ্রহ নেই। বরং এ ব্যাপারে তাদের তাগিদ রয়েছে। অথচ বিআরটিএ এবং গণপরিবহণের একটি সংঘবদ্ধ চক্রের কারণে তারা তা করতে পারছে না। যদিও বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা জানান, বিআরটিএর নিয়ম অনুযায়ী, রুট পারমিটের জন্য কোনো বাধা নেই। 

একজন সেবা গ্রহণকারী সংশ্লিষ্ট বিআরটিএ অফিসে নির্ধারিত ফরমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ফিসহ তার মোটরযানের জন্য রুট পারমিট ইসু্য/নবায়নের জন্য আবেদন করেন। অতঃপর বিআরটিএ অফিস কর্তৃক তার আবেদন যাচাই-বাছাই করে সঠিক পাওয়া গেলে আঞ্চলিক পরিবহণ কমিটিতে (আরটিসি) উপস্থাপন করা হয়। কমিটিতে অনুমোদিত হলে সদস্য সচিব (সহকারী পরিচালক) রুট পারমিট ইস্যু নবায়ন করে গ্রাহককে সরবরাহ করেন। এজন্য ১০ থেকে ২০ দিন সময় লাগে। আবেদনের সময় আট ধরনের কাগজপত্র সঙ্গে জমা দিতে হয়। তবে পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, বিআরটিএ যত সহজ প্রক্রিয়ার কথা বলছে, বিষয়টি আসলে তত সহজ না। অনেক জটিল প্রক্রিয়া। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কেউই রুট পারমিট পান না। আর এখন বিআরটিএ থেকে রুট পারমিট সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। কোনো তদ্বির করাও সম্ভব না। এখন বেশিরভাগ যানবাহনের রুট পারমিট পেতে রাজনৈতিক পরিচয় ও প্রভাবের প্রয়োজন হয়। রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া ঢাকাসহ সারাদেশে নতুন বাস-মিনিবাস নামানো অসম্ভব। 

সাধারণ বাস মালিকরা জানান, রুট পারমিট পেতে প্রথম বাধা হচ্ছে পরিবহণ মালিক সমিতিগুলোর চাঁদাবাজি। একটি বাস রাস্তায় নামানোর আগেই মালিক সমিতির সদস্যপদ নিতে হয়। এই সদস্যপদ পেতে গুনতে হয় লাখ লাখ টাকা। উপরন্তু বিআরটিএর কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার বিষয়ও আছে। মালিক সমিতিকে চাঁদা না দিয়ে রুট পারমিটের জন্য আবেদন করা হলে নানা অজুহাতে তা আটকে দেয়া হয়। কিন্তু রুট পারমিট না পেলেও এসব বাস গ্যারেজে বসে থাকে না। রাস্তায় নেমে বছরের পর বছর যাত্রী পরিবহণ করছে। তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহর দাবি, “রুট পারমিট ছাড়া কোনো বাস চলুক এটা তারাও চান না। এখন রুট পারমিট দেওয়া বন্ধ রয়েছে। কেন বন্ধ রাখা হয়েছে তারা তা জানেন না। এটি বিআরটিএরই ভালো জানা। রুট পারমিটের জন্য মালিক সমিতিতে কোনো বাস মালিককে এখন আর চাঁদা দিতে হয় না। সবকিছু কাগজপত্র এবং বিআরটিএর ওপর নির্ভর করে বলে দাবি করেন এনায়েত উল্লাহ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, “ঢাকা শহরে রুট পারমিটের কোনো কমতি নেই। এর আগে বিআরটিএ প্রয়োজনীয় ও যথাযথ সমীক্ষা ছাড়াই রুট পারমিট দিয়েছে। এতে রাস্তায় যানজট বেড়েছে।” 

রাজধানীতে প্রধানত উত্তর-দক্ষিণমুখী বড় রাস্তা চারটি। উত্তরা, মিরপুর, গাবতলী থেকে এগুলো ঢাকার দক্ষিণে গিয়েছে। পশ্চিম থেকে পূর্বমুখী রাস্তা আছে মাত্র দুটি। এর মধ্যেই কমপক্ষে ১৭০টি রুট তৈরি করা হয়েছে। রুটের এ অযৌক্তিক বিন্যাসের কারণেই নগরীতে যানজট, যাত্রী ভোগান্তি ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, রুট পারমিট পাওয়া নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। বিআরটিএ এবং পরিবহণ মালিক সমিতির লোকজন এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তারা সততার সঙ্গে রুট পারমিট দিলে ঢাকার রাস্তায় অবৈধ কোনো গাড়ি চলত না। ভবিষ্যৎ চিন্তা করে রুট তৈরির ক্ষেত্রেও বিআরটিএকে আরও দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি। 

পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন আগেই রেশনালাইজেশনের পরিকল্পনা করা হলেও গত কয়েক বছর ধরে তা কমিটি গঠন আর বৈঠকেই ঘুরপাক খাচ্ছে। টার্মিনাল নির্মাণের জন্য এখনও জমি নির্বাচন হয়নি। তৈরি হয়নি যাত্রী ছাউনি ও বাস বে। ফলে আটঘাট না বেঁধে রেশনালাইজেন পদ্ধতিতে গাড়ি পরিচালনা করা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। পরিবহণ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, রুট পারমিটবিহীন বাস-মিনিবাস আটকে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করা হলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকায় তা ভেস্তে গেছে। বরং অভিযানের আগাম খবর পেয়ে বাস মালিক-শ্রমিকরা তাদের রুট পারমিটবিহীন গাড়ির সঙ্গে অন্য গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে বাস সংকটে গণপরিবহণ যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে অভিযান বন্ধ করতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডক্টর শামছুল হক বলেন, পৃথিবীর কোনো শহরে এত রুট, এত বাস কোম্পানি নেই। রাজনৈতিক বিবেচনায় রুট পারমিট দিয়ে গণপরিবহণ ব্যবস্থাকে মেরে ফেলা হয়েছে। ঢাকাকে বাঁচাতে রুট কমিয়ে, রুটভিত্তিক অপারেটরের বাস পরিচালনা যত দ্রম্নত সম্ভব শুরু করা দরকার। এ ক্ষেত্রে যত দেরি হবে, শহরের তত ক্ষতি হবে।