নকশা অনুমোদনে কেলেঙ্কারি, জাল সনদে সাগরে চলে জাহাজ

Passenger Voice    |    ০৪:০৪ পিএম, ২০২১-০৮-০৫


নকশা অনুমোদনে কেলেঙ্কারি, জাল সনদে সাগরে চলে জাহাজ

সামসুদ্দীন চৌধুরীঃ   সারা দেশে অনিবন্ধিত কত সংখ্যক নৌযান চলছে- এমন কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে। শুধু তাই নয়, কোন অঞ্চলের নদ-নদীতে কি ধরনের যাত্রী বা পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করছে, এরও কোনো তথ্য ভাণ্ডার নেই। অবৈধ এসব নৌযান চলায় একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অপরদিকে বাড়ছে নৌ খাতে বিশৃঙ্খলা। সেইসঙ্গে বাড়ছে দুর্ঘটনাও। এত কিছুর পরও নির্বিকার কর্তৃপক্ষ। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

অন্যদিকে নকশা অনুমোদনে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে ২০১৮ সালে পর পর দু'জন প্রধান প্রকৌশলী দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের জালে আটক হয়। তাদের এ পরিণতিতে নৌপরিবহন অধিদপ্তরসহ গোটা নৌপরিবহন খাত চরম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তীব্র সমালোচিত হচ্ছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এর পরও সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা এ ধরনের অনিয়ম থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি বলেও অভিযোগ রয়েছে। 

সারাদেশের এসব নৌযানের সার্বিক কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্ব সরকারের দুই সংস্থা- নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌ পরিবহণ অধিদপ্তর। সংস্থা দুটির ঊর্ধ্বতন কয়েক কর্মকর্তাদের মতে, সারা দেশে নিবন্ধিত যে সংখ্যক (১২ হাজার ৯৫৯টি) নৌযান রয়েছে, তার বেশি রয়েছে অনিবন্ধিত নৌযান। নৌযান মালিক ও শ্রমিক নেতাদের মতে, সারা দেশে অনিবন্ধিত বালুবাহী (বাল্কহেড) জাহাজ, ট্রলার ও স্পিডবোট মিলিয়ে অন্তত ২০ হাজার নৌযান চলছে। আইনগতভাবে নিবন্ধনহীন ১৬ হর্স শক্তির বেশি ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এদিকে নকশা অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা জাহাজ গুলোর সাগরে চলাচল করছে। এক শ্রেনির অসাধু ব্যক্তিদের মাধ্যমে জাল সনদ নিয়ে এইসব লঞ্চ চলাচল করছে। সাম্প্রাতিক সমূদ্রে জাল সনদ নিয়ে চলাচল করা অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে চট্টগ্রাম কোস্টগার্ডের জালে ধরা পড়েছে ‘এমভি লা মেরিন-২’ জাহাজ। জাহাজটি নির্মাণের জন্য হোমল্যান্ড শিপিং লাইনের মালিক মো. জাকির হোসেন নৌপরিবহন অধিদপ্তরে আবেদন করেছেন। তবে জাহাজটি সমূদ্রে চলাচল করলেও  জাহাজের নকশা এখনও অনুমোদন হয়নি বলে খোদ জাকির হোসেনই স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ জাহাজ এখনো তৈরি হওয়ার কথা নয়; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে পণ্য পরিবহন করছে। এই ঘটনায় জাহাজটি আটক করে মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। 

জাহাজ নির্মাণের নকশা জমা দিয়েই সাগরে পণ্য পরিবহন শুরু করে এমভি লা মেরিন-২ এই জাহাজটি। জাহাজের নকল সনদ তৈরি করে সাগরে নামানো হয়। ওই জাহাজে থাকা মাস্টারের সনদও জাল পাওয়া গেছে কোস্টগার্ডের অভিযানকালে। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে সার্ভে সনদ তৈরি করে তা প্রদর্শন করা হয়েছে। মালিক জাকির হোসেন জালিয়াতির কথা স্বীকার না করলেও প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ রয়েছে বলে জানিয়েছে নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও নৌ-বাণিজ্য দপ্তর চট্টগ্রাম এর কাছে। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের একটি জালিয়াত চক্রকে ম্যানেজ করে জাল সার্ভে সনদ তৈরি করেছেন জাকির। সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে ফাঁকি দিতেই নকশা অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা জাহাজের নকল সনদ দেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে জাহাজটি চলছিল। এ ধরনের মিথ্যা তথ্যে চলাচলকারী জাহাজের জন্যই বন্দর চ্যানেলে দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে বন্দর চ্যানেল। সপ্তাহ খানেক আগে বাংকার বার্জ (আউটাসে আসা বিদেশি জাহাজে তেল সরবরাহকারী) একটি জাহাজ ডুবে গেছে চট্টগ্রামের সমূদ্রে। জাহাজে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করায় উত্তাল বঙ্গোপসাগরের চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় এই জাহাজটি ডুবে যায়। এর আগে ডুবো জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুইটি লাইটার জাহাজও দুর্ঘটনায় পরেছিল।

অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশের ৮১ ধারা অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএর ৪৭ জন কর্মকর্তাকে অনিবন্ধিত ও ফিটনেসবিহীন নৌযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আইনগত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা খুব কমই ওই আইনের প্রয়োগ করেন। অনেক ক্ষেত্রে নিবন্ধনহীন জাহাজ থেকে কনজারভেন্সি চার্জ আদায়ের মাধ্যমে তাদের বৈধতা দেন কোনো কোনো কর্মকর্তা। এছাড়াও বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসির অনেক জাহাজের নিবন্ধন নেই বলেও একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। 

নকল সার্ভে সনদে জাহাজ চলাচল করায় এমভি লা মেরিন-২-এর মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন অভ্যন্তরীণ জাহাজ পরিদর্শনালয়ের পরিদর্শক আবু জাফর মিয়া। নৌ আদালতে করা মামলায় অভ্যন্তরীণ নৌ চালাচল আইনের ৩৩, ৫৪(ক), ৫৬ ও ৬৬ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

নৌ পরিবহণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১৯৯১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে ৬০২টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৭৩৫ জন মারা গেছেন। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ৫২৬ জন ও নিখোঁজ হয়েছেন ৫০১ জন। চলতি বছরেই বড় দুটি নৌ দুর্ঘটনায় সারা দেশে আলোচনায় আসে। একটি হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে এসকে-৬ নামের একটি মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় এমএল সাবিত আল হাসান ডুবে ৩৫ জনের মৃত্যু হয়। সর্বশেষ মাওয়ায় স্পিডবোট দুর্ঘটনায় ২৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। ওই স্পিডবোটটিও নিবন্ধন ছাড়াই চলছিল। 

নিয়ম অনুযায়ী, নৌযানের নকশা নৌ পরিবহণ অধিদপ্তর থেকে অনুমোদনের পর সেই নকশা অনুযায়ী নৌযান নির্মাণ করতে হবে। নির্মিত নৌযান পরিদর্শন করে রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস সনদ দেন সার্ভেয়াররা। ওই সনদ দুটি দেখিয়ে বিআইডব্লিটিএ থেকে রুট পারমিট নিতে হয়। এরপরই নৌযানটি চলাচলের জন্য উপযুক্ত হয়। বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ শুধু যাত্রীবাহী ৭৮০টি নৌযানের রুট পারমিট দিয়েছে। তবে ফি অনুমোদন না পাওয়ায় পণ্যবাহী নৌযানের রুট পারমিট দেয়া শুরু করেনি।

চলতি বছরের ২৯ জুলাই নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন মো. গিয়াসউদ্দিন আহম্মেদ জরুরী বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বলেছেন, বর্তমানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মালবাহী কার্গো ভ্যাসেল, ট্যাংকার, ট্রলার, ফিশিং বোট, কার্গো বোট নকল সনদ (রেজিস্ট্রেশন সনদ ও বার্ষিক সার্ভে সনদ) নিয়ে চলাচল করছে। নীরিক্ষায় দেখা যায়, এসব নৌযানে কর্মরত আছেন বহু মাস্টার, চালক ও স্কিপারের সনদও জাল। এ ছাড়া অনিবন্ধিত বাল্ক হেড দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে মালামাল লোড/আনলোড করা হচ্ছে।  জাল সনদ ও অনিবন্ধিত নৌযান চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল, জান-মাল ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনায় বহির্বিশ্বে বন্দরের সুমান ক্ষুন্ন হয়েছে। সরকার হারাচ্ছে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব। জাল সনদ ও বাল্কহেড দিয়ে পণ্য পরিবহন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানান শীর্ষ এই কর্মকর্তা।

নৌ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে নিবন্ধিত নৌযান রয়েছে ১২ হাজার ৯৫৯টি। এর মধ্যে যাত্রীবাহী লঞ্চ ৮৩৯টি, যাত্রীবাহী বোট ৪১৭টি, স্পিডবোট ৩০৩টি, মালবাহী জাহাজ ৪ হাজার ০৮৮টি, বালিবাহী ৪ হাজার ৯১০টি, ড্রেজার ১ হাজার ২৬৯টি, ফেরী ৪০ টি, তৈলবাহী নৌযান ৩৩৩ টি, টাগবোট ১৪৭ টি, ডামবার্জ  ৪৫৩ টি। এর বাইরে কতটি নৌযান নিবন্ধন ছাড়াই চলাচল করছে তা নিরূপণে ২০১৬ সালে ন্যাশনাল শিপস অ্যান্ড মেকানাইজড বোটস ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং নামের একটি প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করেছিল নৌ পরিবহণ অধিদপ্তর। ওই সময়ে ৪৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ৩ বছরে সারা দেশের নৌযানের ডাটাবেজ তৈরির কথা ছিল। ওই ডিপিপি এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি সংস্থাটি। ফলে নিবন্ধনহীন নৌযানের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান তৈরি করতে পারেনি।

২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল সৈয়দ শিপিং লাইনের একটি যাত্রীবাহী জাহাজের নকশা অনুমোদনের জন্য নগদ পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ নিতে গিয়ে দুদকের জালে ফেঁসে যান নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী এসএম নাজমুল হক। পরে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদকালে দুদকের কাছে  নকশা অনুমোদনের জন্য ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ গ্রহণের তথ্য ফাঁস করেন তিনি। এর আগে ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই নিজ কার্যালয়ে বসে নকশা অনুমোদনের ঘুষ গ্রহণ কালে দুদকের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী একেএম ফখরুল ইসলাম। জাহাজের নকশা অনুমোদনের জন্য ঘুষ কেলেঙ্কারি এবং  পরপর দু'জন প্রধান প্রকৌশলী গ্রেফতারের ঘটনায় নৌপরিবহন অধিদপ্তর চরম বিতর্কের মুখে পড়লেও অনুমোদন প্রক্রিয়ায় আগের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা ফলে এখনও নকশা অনুমোদন ছাড়া এইসব জাহাজ সমুদ্রে চলাচল করছে।