কৌশলে রেলের রাজস্বের ক্ষতি করেছে ডিসিও আনসার আলী বলছে অডিট রিপোর্ট

চাহিদা নেই, তবুও মালামাল কিনে রেলের ক্ষতি করে আনসার আলী পর্ব-৩

Passenger Voice    |    ১১:৩৪ এএম, ২০২১-০২-১২


চাহিদা নেই, তবুও মালামাল কিনে রেলের ক্ষতি করে আনসার আলী পর্ব-৩

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিভিন্ন সময় রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গণমাধ্যমকে বলেছেন, রেলে দুর্নীতি নেই এটা বলব না। তবে বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহন করেছে। আমরা সেই নীতিতে অব্যাহতভাবে আমাদের কাজ করে যাব। রেলের কেনাকাটার বিষয়ে তিনি বলেন, কেনাকাটায় সুর্নিদিষ্ট দুর্নীতির তথ্য যদি আপনারা (সাংবাদিকরা) দিতে পারেন কোথায় দুর্নীতি হচ্ছে বা কিভাবে দুর্নীতি হয়েছে এ রকম তথ্য দিতে পারলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নিব। এর সাথে যে বা যারাই জড়িত থাকুক, যত বড় শক্তি দুর্নীতি করুক আমরা ব্যবস্থা নিব।

সরকারের এমন কঠোর হুশিয়ারী দেয়ার পরে ইতিমধ্যে রেলের তিন শীর্ষ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করে শাস্তির আওতায় আনা হলেও কতিপয় দুর্নীতিবাজ ডজনখানেক বেপরোয়া কর্মকর্তাদের লাগাম টেনে ধরা কোন ভাবে সম্ভব হচ্ছে না বলে মন্তব্য করছেন রেল বিশ্লেষকরা। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার কার্যালয় ঘিরে চলমান অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে প্যাসেঞ্জার ভয়েসের পাঁচ পর্বের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব “দুর্নীতির বাহুবলে রাঘববোয়াল পূর্বরেলের ডিসিও আনসার আলী” শিরোনামে গত ২ ফেব্রুয়ারী প্রকাশ হয়, গত ৬ ফেব্রুয়ারী একই কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সরকারি বাসাবাড়ি নিয়ে বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে “ সরকারি বাসা ভাড়া দিয়ে নগদ টাকা গুনে রেলের ডিসিও আনসার আলী” শিরোনামে ২য় পর্ব প্রকাশিত হলে কিছুটা নড়েছড়ে বসে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে প্যাসেঞ্জার ভয়েসের প্রতিবেদককে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের হুমকি ধুমকি প্রদান সহ মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার বিষয়েও ডিসিও আনসার আলীর কতিপয় কর্মচারীরা চেষ্টা করেন। এদিকে পরিবহন সেক্টরের সকল খুঁটিনাটির বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে প্যাসেঞ্জার ভয়েস বদ্ধপরিকর হওয়ায় ডিসিও অফিসের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে পাঠকদের জন্য আজ ৩য় পর্ব প্রকাশ করা হলো।

বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় বাণিজ্যিক কার্যালয়ে করোনা কালে জরুরি প্রয়োজন দেখিয়ে এলটিএম পদ্ধতিতে (লিমিটেড টেন্ডার মেথড) রেলের খুচরা সরঞ্জাম ক্রয় করে সরকারের বিপুল পরিমান আর্থিক ক্ষতি করার বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে পরিবহন অডিট অধিদপ্তরের নিরিক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারী পরিবহন অডিট দপ্তরের একটি টিম পূর্ব রেলের ডিসিও (চট্টগ্রাম) অফিসে অডিট কার্যক্রম পরিচালনা করে।

আরও পড়ুন >>> রেলের কেনাকাটায় এলটিএম পদ্ধতিতে এক চক্রের নিয়ন্ত্রণে সব---সংসদীয় কমিটিতে ক্ষোভ

প্যাসেঞ্জার ভয়েসের রাজশাহী প্রতিনিধি আমির হোসাইন রাজশাহীর পরিবহন অডিট অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ের অডিট এন্ড একাউন্টস অফিসার বিভাশ মৈত্র এর স্বাক্ষরিত কিছু অডিট আপত্তির কপি পর্যালোচনা করে বলেন, কতিপয় পছন্দের ঠিকাদারকে দিয়ে এলটিএম পদ্ধতিতে রেলের মালামাল ক্রয়ে বেশি আগ্রহ দেখায় কর্মকর্তারা। খুচরা সরঞ্জাম কেনার নামে মোটাদাগে খরচ দেখানো হচ্ছে পূর্বাঞ্চল রেলে। ঘুরেফিরে পছন্দের ঠিকাদার সিন্ডিকেটকে দিয়ে বিভাগীয় বাণিজ্যিক কার্যালয়ে সব কেনাকাটার নিয়ন্ত্রণ করে ডিসিও।  অভিযোগ আছে তিনি নিজেই ঠিকাদারদের সাথে সকল  কেনাকাটায় জড়িত। টেন্ডারে অনিয়ম ও সরকারি অর্থ অপচয় রোধে ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) টেন্ডার সিস্টেম চালু রয়েছে। তবে অভিযোগ আছে পূর্বরেলের ডিসিও আনসার আলী জরুরি দেখিয়ে প্রায় সময় পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে বিধিবদ্ধ দরপত্র আহ্বান না করে এলটিএম পদ্ধতিতে কোন প্রতিযোগিতা ছাড়ায় এই দপ্তরের কেনাকাটা করে থাকেন। 

রাজশাহী প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য বিশ্লেষন করে দেখা যায়ঃ 

পরিবহন অডিট অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ের অডিট এন্ড একাউন্টস অফিসার বিভাশ মৈত্র স্বাক্ষরিত একটি অডিট আপত্তির কপিতে তিনি উল্লেখ্য করেছেন, প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক বাংলাদেশ রেলওয়ে সিআরবি, চট্টগ্রাম কার্যালয়ের আওতাধীন বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর কার্যালয়ের ২০১৯-২০ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষাকালে মাঠপর্যায়ের ভোক্তার চাহিদা ব্যতীত এলটিএম পদ্ধতিতে মালামাল ক্রয় করে ফেলে রাখায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে ২,৫০,৮০০ টাকা।

ডিসিও কার্যালয়ের এ সংক্রান্ত নথি/চুক্তিপত্র নং-ডিসিও/এস/রিভিট (বড়) , ডিসিও এস/রিভিট (ছোট) তারিখ-০৫-০৫-২০২০ এ ২ টি চুক্তিপত্রের মাধ্যমে মোট (৬০০+৬০০) ১২০০ কেজি রিভিট ক্রয় করা হলেও ক্রয়কৃত রিভিটের জন্য মাঠপর্যায় হতে কোন ধরনের চাহিদা পাওয়া যায় নি।

এছাড়াও জরুরী প্রয়োজন দেখিয়ে এলটিএম এর মাধ্যমে ক্রয় দেখানো হলেও নিরীক্ষা চলাকালীন ২০২১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত মালামাল সমূক ইস্যু করা হয়নি। তাই চাহিদা ছাড়া মালামাল ক্রয় করে ফেলে রাখায় ডিসিও চট্টগ্রাম দপ্তরটি সরকারের ২,৫০,৮০০ টাকা ক্ষতি হয়েছে। 

এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা ডিসিও আনসার আলীকে তার সরকারি মুঠোফোনে ফোন করলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। 

অডিট টিমের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, এলটিএম পদ্ধতিতে মালামাল ক্রয়ের বিষয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ এ বলা হয়েছে, বিশেষায়িত প্রাকৃতিক পণ্য যাহা কেবল সীমিত সংখ্যক সরবাহকারীর নিকট পাওয়া যায়। অথবা সরকারি নীতি থাকিলে কমমূল্যে কিছু মালামাল ক্রয় করে মজুদ করার বিধান আছে অথচ এই কেনাকাটায় এই আইনটি কোনভাবে মানা হয়নি। যা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) আইন ২০১৬ এর ৭ ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে।

রেলে কেনাকাটায় এমন অনিয়ম করে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তা বরখাস্ত হয়েছে এবং তদন্তকারী কর্মকর্তারাও তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারী মামলা করার সুপারিশ করেছেন। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইনের ৬৪ নং ধারার ৩/৪ উপধারায় কোন সরকারি কর্মকর্তা এই ধরনের কেনাকাটায় অনিয়ম করে থাকে তাহলে government servants (discipline and appeal rule 1985 এর rule 3 (b) এবং 3(d) বা উক্ত কর্মকর্তা কর্মচারীর ক্ষেত্রে বিধি অনুযায়ী অসদাচরণ বা দুর্নীতির জন্য দাযী করে বিভাগীয় শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। prevention of corruption act 1947 এর আওতায়  penal code-1860  এর অধিনে ফৌজদারী কার্যক্রম গ্রহন করা যাবে। 

এ বিষয়ে পূর্বাঞ্চল রেলের প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক সিসিএম নাজমুল ইসলাম এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অডিট পরিচালনার সময় বেশ কিছু বিষয়ে অডিট কর্মকর্তারা আপত্তি দিয়েছে সেটা শুনেছি। তবে এই বিষয়ে অডিট অধিদপ্তরকে ডিসিও জবাব প্রদান করবে। কোন ধরনের অনিয়ম দুর্নীতি হয়ে থাকলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এই বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিঃ মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলীর সাথে যোগাযোগ করা হয়। তবে শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় প্যাসেঞ্জার ভয়েসের সাথে তিনি কথা বলতে পারেনি।