বিআরটিএর চেয়ারম্যানের আদেশকেও দেখিয়েছে বৃদ্ধাঙ্গুলি

মোটা টাকার ঘুষ নিয়ে গাড়ির ফিটনেস দেয় ঝিনাইদহ বিআরটিএর পরিদর্শক মঈদুর

Samsuddin Chowdhury    |    ১০:৪৫ এএম, ২০২১-০২-০৮


মোটা টাকার ঘুষ নিয়ে গাড়ির ফিটনেস দেয় ঝিনাইদহ বিআরটিএর পরিদর্শক মঈদুর

সামসুদ্দীন চৌধুরীঃ ফিটনেস প্রদানে বিআরটিএ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহনের অভিযোগ অনেক পুরানো। সাথে আছে গাড়ি না দেখে ফিটনেস প্রদানের প্রবণতা। বিআরটিএ প্রশাসন বারবার রক্তচক্ষু দেখালেও চেয়ারম্যানের আদেশকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় কতিপয় মোটরযান পরিদর্শক। সাম্প্রতিক সময়ে প্যাসেঞ্জার ভয়েস বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ ঝিনাইদহ , যশোর-নড়াইল ও রাজশাহী সার্কেল নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে। অনুসন্ধানে এইসব সার্কেলের বেশ কিছু অনিয়ম দুর্নীতির তথ্য উপাত্ত প্যাসেঞ্জার ভয়েসের হাতে এসেছে। 

২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর ৩৫.০০.০০০০.০২০.২২.০৪১.১৮-৬৯৯ নং সংক্ষক প্রজ্ঞাপন জারি করে রেজিষ্ট্রেশনকৃত মোটরযানের ফিটনেস যে কোন সার্কেল থেকে করার অনুমতি দিয়েছিল বিআরটিএ। এই আদেশের পরে বিআরটিএর বিভিন্ন সার্কেলের কতিপয় দুর্নীতিবাজ মোটরযান পরিদর্শক যানবাহন পরিদর্শন না করে মোটা টাকার ঘুষের বিনিময়ে লক্কর, ঝক্কর গাড়িকে ফিটনেস প্রদান করা শুরু করেছিল। এইসব দুর্নীতিবাজ মোটরযান পরিদর্শকদের বেপরোয়া স্বভাব দেখে ২০২০ সালের ৪ অক্টোবর ৩৫.০৩.০০০০.০০৩.২৫.০৩৬.১৯-২৬৯৮ নং স্বারকে আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে এই কর্মকর্তাদের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করেছে বিআরটিএ। তবে এমন নির্দেশনা মানতে নারাজ বিআরটিএর কতিপয় ঘুষখোর কর্মকর্তা। সংস্থাটির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কোন দৃশ্যমান শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় এইসব কর্মকর্তারা চরমভাবে বেপরোয়া হয়ে যায়। 

এদিকে ২০২০ সালের ৪ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি পযর্ন্ত ৮৪ কর্মদিবসে বিআরটিএর ঝিনাইদহ সার্কেলে ২৫৫৭ টি  ফিটনেস সনদ ইস্যু করে মোটরযান পরির্দশক মঈদুর রহমান। প্যাসেঞ্জার ভয়েসের অনুসন্ধান বলছে মঈদুর রহমানকে প্রতিটি গাড়ির বিপরীতে দিতে হয়েছে মোটা অংকের ঘুষ। ২৫৫৭ টি ফিটনেস প্রদানে অন্তত ৫১ লাখ টাকা লেনদেন হওয়ার বিষয়েও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এই গাড়িগুলোর মধ্যে ৭৫ শতাংশ গাড়ি বিভিন্ন সার্কেলের নিবন্ধিত, শুধুমাত্র ২৫ শতাংশ গাড়ি ঝিনাইদহ জেলার। 

প্যাসেঞ্জার ভয়েস অনুসন্ধানের প্রথমে নজর দিয়েছে এই সার্কেলের ফিটনেস প্রদান করা বাস ও মিনিবাসের দিকে। গতবছরের ৪ অক্টোবর থেকে ২৭ জানুয়ারী পর্যন্ত বিভিন্ন দিনে এই মোটরযান পরিদর্শক মেহেরপুর-জ-১১-০০০৯, কুষ্টিয়া-ব-১১-০০১৯, ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৪৪২৭, ঢাকা মেট্রো-জ-১৪-০৭০৮, পাবনা-জ-১১-০০৭৮, ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৭৭৩৩, ঢাকা মেট্রো-ব-১৫,০৮৫১, ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৩৪৭২, বরিশাল-জ-১১-০০৩১, যশোর-ব-১১-০১২৬, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৩৫৩৪, ঢাকা মেট্রো-ব-১১-১২২৬, ঢাকা মেট্রো-ব-১১-২৩৮৬, যশোর-ব-১১-০০৮৭, ঢাকা মেট্রো-ব-১৩-০০৬০, পাবনা-জ-১১-০০৮২, ঢাকা মেট্রো-জ-১৪-০৪৩৮ ঢাকা মেট্রো-ব-১১-১৩৪৫, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৮৯০৬, হবিগঞ্জ-জ-১১-০০০২, ঢাকা মেট্রো-জ-১১-১২৩৯, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৭৭৬৫, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৯৪৭৩, ঢাকা মেট্রো-জ-১৪-০৩৫৩, ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৭২৯৬, যশোর-ব-১১-০১১৪, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৮৮৫৪, ঢাকা মেট্রো-ব-১১-১৫৭৩, ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৯৯১৯, ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৯৯২০, নড়াইল-ব-১১-০০০১, ঢাকা মেট্রো-ব-১১-১১-৪০৬১, ঢাকা মেট্রো-জ-১৪-০৯৬৪, ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৩৯২০, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-০২৯৯, গাজিপুর-জ-০৪-০৩৪৯, নেত্রকোনা-জ-১১-০০০১, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-১৫২৪, সিলেট-জ-১১-০৭৯৭, যশোর-জ-১১-০১৪৮, ঢাকা মেট্রো-জ-০৪-০৮৭৪, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৭৫২৩, ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৫৮৪২, ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৫৮৪১, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-১০৬৫, ঢাকা মেট্রো-জ-১৪-২৩৪২, মেহেরপুর-জ-১১-০০০১, ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৩৮২১ ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৭৯৬২, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৭৫১২, ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৫৫৭২, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৭৭৬৭, কুমিল্লা-জ-০৫-০০০১, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৩০৪১, পাবনা-জ-১১-০০২১ নং বাস মিনিবাসের ফিটনেস ইস্যু করেছে।

ইস্যু করা ফিটনেস সনদ গুলোর বিষয়ে বিআরটিএ সদর কার্যালয় বলছে, ইফাদ মোটরর্স এর নামে নিবন্ধিত ঢাকা মেট্রো-ব-১৫,০৮৫১ এই বাসটি ঢাকা মহানগরীর সিটি সার্ভিস, গাড়িটির রুট পারমিট দেয়া আছে কাঁচপুর টু টঙ্গী পর্যন্ত। সূত্র বলছে এই গাড়িটি কখনো ঝিনাইদহ জেলায় যায়নি তবুও ২০২০ সালের ৪ অক্টোবর ফিটনেস দিয়েছে ঝিনাইদহ সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক মঈদুর রহমান।  বিআরটিএর আদেশ অমান্য করে এই গাড়ির ফিটনেস প্রদানে ১০ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহনের অভিযোগ পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে। টাঙ্গাইল দেলদোয়ার এলাকার সাইফুল ইসলামের মালিকানাধীন ঢাকা মেট্রো-জ-১৪-০৭০৮ নং গাড়িটি ঢাকা থেকে নেত্রকোনা নাগরপুর পর্যন্ত চলাচলের জন্য গাড়িটিকে রুট পারমিট দিয়েছে বিআরটিএ।

অথচ এই গাড়িকেও ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর ফিটনেস প্রদান করেছে এই মোটরযান পরিদর্শক। ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৭৭৩৩ ও ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৩৪৭২ নং বাস দুইটি ঢাকা থেকে কুড়িগ্রাম পর্যন্ত চলাচলের পারমিট দিয়েছে বিআরটিএ। গত বছরের ১৯ অক্টোবর ও ৪ অক্টোবর এই গাড়ি গুলোর ফিটনেস দেয় এই পরিদর্শক। এভাবে  ঢাকা মেট্রো-ব-১১-১২২৬ এই বাসটির পারমিট চট্টগ্রাম থেকে রংপুর, পাবনা-জ-১১-০০৮২ কুষ্টিয়া থেকে বগুড়া, ঢাকা মেট্রো-জ-১৪-০৪৩৮ বাসটি ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল, ঢাকা মেট্রো-জ-১১-১২৩৯ গাড়িটি যশোর থেকে কালীগঞ্জ, ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৭৭৬৫ গাড়িটি সিলেট থেকে নীলফামারী, ঢাকা মেট্রো-জ-১৪-০৩৫৩ ঢাকা থেকে নাজিরপুর, ঢাকা মেট্রো-ব-১১-১১-৪০৬১ ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ হালুয়াঘাট, ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৩৯২০ ও যশোর-জ-১১-০১৪৮ নং বাস ও মিনিবাসের এখনও রুট পারমিটও ইস্যু করেনি বিআরটিএ।

২০২০ সালের ৪ অক্টোবর বিআরটিএর চেয়ারম্যানের আদেশে স্পষ্ট উল্লেখ্য ছিল যে, যে গাড়িটির রুট পারমিট যে রুটে রয়েছে ওই গাড়িটি চলাচলের রুটের যে কোন সার্কেল উক্ত গাড়ির ফিটনেস প্রদান করতে পারবে। রুটে চলাচলের বাধ্যবাধকতা লঙ্গিত হচ্ছে এমন কোন গাড়ি অন্য সার্কেল ফিটনেস প্রদান করার কোন সুযোগ নেই। বিআরটিএ সদর কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী এই বাস ও মিনি বাস ঝিনাইদহ এলাকায় যাওয়া কোন ভাবে সম্ভব নয়। প্যাসেঞ্জার ভয়েসের সূত্র বলছে এই যানবাহন গুলো পরিদর্শন না করে প্রতি গাড়ি প্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা করে ঘুষ গ্রহনের মাধ্যমে ফিটনেস সনদ ইস্যু করেছে বিআরটিএ ঝিনাইদহ সার্কেল মোটরযান পরিদর্শক মঈদুর রহমান। তবে এমন অপকর্ম করে কোন ভাবে অনুতপ্ত নন তিনি। তার মতে তার সকল অপকর্মের ভাগ এই সার্কেলের সকল কর্মকর্তা পেয়ে থাকেন। 

এদিকে সরকারী চাকরির বিধিমালায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, কর্তব্যে অবহেলা বা সরকারী আদেশ অমান্য করণে সরকারি কর্মকর্তার শাস্তির বিধান। এমন অপরাধে উক্ত কর্মকর্তার Compulsory retirement, removel from service, dismissal from service, reduction to a lower post or time-scale এমন সাজাও হতে পারে। 

বিআরটিএ ঝিনাইদহ সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক মঈদুর রহমান প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমি বিআরটিএর আদেশ অমান্য করে কোন কাজ করিনি। বাকি সব প্রশ্নের জবাব সহকারী পরিচালক দিবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। 

এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ ঝিনাইদহ সার্কেলের সহকারী পরিচালক এস এম মাহফুজুর রহমান প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, যানবাহনের ফিটনেস মোটরযান পরিদর্শক দিয়ে থাকেন, ফিটনেস প্রদানের অনিয়মের বিষয়ে যদি কোন সুর্নিদিষ্ট অভিযোগ উঠে তাহলে আমি বিষয়টি সদর কার্যালয়ে লিখিত ভাবে জানাবো।