চাকরি জীবনে প্রায় ২০০ কোটি টাকা অবৈধ আয়ের অভিযোগ

রেলের রাজস্বের টাকা চুরি করে কানাডার বেগমপাড়ায় সিওএস বেলাল!

Passenger Voice    |    ০৭:৩৭ পিএম, ২০২১-০১-১৯


রেলের রাজস্বের টাকা চুরি করে কানাডার বেগমপাড়ায় সিওএস বেলাল!

সামসুদ্দীন চৌধুরী: ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভিন্ন স্টেশনের মালপত্র কেনাকাটায় হরিলুটকারি পূর্বাঞ্চল রেলের সাম্প্রতিক বহিস্কার হওয়া সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিওএস) বেলাল হোসেন সরকার কানাডায় পালিয়ে যাওয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। বিষয়টি নিশ্চিত হতে বেলাল হোসেন সরকারের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন ০১৭৫২----৫১৮, সরকারি ফোন ০১৭১১----৬৫২ নং নম্বরে কল করা হলে মোবাইল গুলো বন্ধ পাওয়া যায়। 

২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে বাংলাদেশ রেলওয়ের সচিব সেলিম রেজার স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে প্রকৌশলী মো. বেলাল হোসেন সরকারকে বহিস্কার করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রকৌশলী মো. বেলাল হোসেন সরকার সিওএস, কন্ট্রোলার অব স্টোরস অফিস (পূর্ব), বাংলাদেশ রেলওয়ে চট্টগ্রাম কর্তৃক সিওএস কন্ট্রোলার অব স্টোরস অফিস (পশ্চিম) বাংলাদেশ রেলওয়ে রাজশাহী থাকাকালীন রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের পণ্য ক্রয়ে আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অডিট ও আইসিটি) ড. ভুবন চন্দ্র বিশ্বাস এর তদন্ত টিম সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র, ক্রয়কৃত পণ্য এবং বাজার হতে সরেজমিনে সংগৃহিত পণ্যের নমুনার বাজারদর যাচাই এবং পারিপাশ্বিক বিষয়াদি বিবেচনাপূর্বক তদন্ত করে এই বেলালের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে সরাসরি জড়িত থাকার প্রমান পায়।

আরও পড়ুন >>> টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সিওএস কিভাবে দায়ী 

দায়িত্বশীল কর্মকর্তার এমন ঘটনা সরকারী (শৃঙ্খলা ও আপীল) বিধিমালা ২০১৮ এর ৩(খ) ও ৩(ঘ) বিধি মোতাবেক অসদাচরণ ও দুর্নীতির পর্যায়ভুক্ত এবং গুরুদন্ড প্রদানযোগ্য অপরাধ হওয়ায় একই আইনের ১২(১) বিধি মোতাবেক তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। 

বহিস্কার হওয়ার একমাস আগে থেকে অফিসে আসা ছেড়ে দেয় বেলাল: প্রকৌশলী বেলাল হোসেন সরকারের অনিয়ম দুর্নীতি ও রাজস্বের টাকা হরিলুটের তথ্য প্রকাশ্যে আসলে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিক থেকে তিনি অফিসে অনুপস্থিত ছিলেন, পরে ১৫ দিনের ছুটি দেখিয়ে কাজে যোগদান করলেও বাকী ১৫ দিন তিনি অফিস করেন নি। পরে তিনি ২৯ ডিসেম্বর বরখাস্ত হন। এদিকে সিওএস দপ্তরের প্রধান হিসেবে সরকারী মোবাইল ফোনও তিনি নিয়ে চলে গেছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন। 

তবে বিষয়টি জানতে কন্ট্রোলার অব স্টোরস অফিস (পূর্ব) এর অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা ফরিদ উদ্দিন এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমি এখনও সিওএস দপ্তরের সরকারী মোবাইল ফোন পায়নি। এমনকি ওই নম্বরটিতে কল দিলেও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। 

অন্য দিকে গত ৭ জানুয়ারী তিনি বাংলাদেশ থেকে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন বলে বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন। তবে এই বিষয়ে রেলওয়ের কোন কর্মকর্তা এই বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। বিষয়টি সিও্এস ফরিদ উদ্দিন এর কাছে জানতে চাইলে তিনি প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমি এই বিষয়ে কিছু জানিনা। সিনিয়র অথরিটি বলতে পারবে। 

এই বিষয়ে কথা বলতে রেলওয়ের অতিঃ মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মোঃ মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরীর সরকারী মোবাইল ফোনে বারবার ফোন করা হলে তিনি কল রিসিভ করেন নি। 

এদিকে বেলাল হোসেন সরকারের অবৈধ দুর্নীতির টাকা তোলার ক্যাশিয়ার উচ্চমান সহকারী নুরুল আমিন তালুকদারও গত বুধবার থেকে অফিসে অনুপস্থিত রয়েছে। 

এদিকে বেলালের কানাডার বেগমপাড়ায় পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বার বার উঠে আসলে একটু খবর নিয়ে জানা যায়। কানাডার 'বেগমপাড়া' এখন শুধু কানাডাই নয়, সারা বিশ্বে আলোচিত। বেগমপাড়ায় ২৮ বাংলাদেশির বাড়ির খোঁজ পেয়েছে বাংলাদেশ সরকার। যার মধ্যে বেশিরভাগেরই মালিক সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা। এ আমলাদের নামের তালিকার খোঁজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তালিকা হাতে পেলেই তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছে দুর্নীতি দমনকারী সংস্থাটি। গতবছরের ১৮ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত মিট দ্যা প্রেস অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বিদেশে এইসব অবৈধভাবে টাকা পাচারকারি আমলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় কথাও বলেছেন। 

যে কারনে কানাডায় পালাতে পারে : সূত্র বলছে কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনার বিষয় বেগমপাড়া। তবে এটি কোনো নির্দিষ্ট এলাকার নাম নয় বা নির্দিষ্ট কোনো এলাকাতেও অবস্থিত নয়। এর বেশিরভাগই টরেন্টো, মন্ট্রিয়ল, অটোয়া শহরে অবস্থিত। মূলত  দেশের ধনী ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের স্ত্রী-সন্তানরা, যারা বিনিয়োগ ভিসায় কানাডায় অভিবাসী হয়েছেন, তাদের এলাকা। স্বামীরা দেশে থেকে অর্থের জোগান দেন, আর স্ত্রীরা সন্তানদের নিয়ে সেই টাকায় কানাডায় থাকেন, সন্তানদের লেখাপড়া করান। এসব এলাকায় যারা বাড়ি করছেন, তারা প্রত্যেকেই অবৈধভাবে অর্থপাচার করেছেন বলে জানা গেছে। এসব এলাকায় স্বামীরা স্থায়ীভাবে থাকেন না, বেড়াতে যান, এজন্য এসব এলাকাকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ডাকেন বেগমপাড়া বলে। হঠাৎ করে বেগমপাড়া আলোচনায় আসার আরেকটি কারণ হলো কানাডার সরকারি সংস্থা দ্য ফিন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন অ্যান্ড রিপোর্ট অ্যানালাইসিস সেন্টার ফর কানাডা (ফিনট্র্যাক) গত এক বছরে তাদের দেশে এক হাজার ৫৮২টি অর্থ পাচারের ঘটনা চিহ্নিত করেছে। 

এদিকে, বেগমপাড়ার বিষয়টি আলোচনায় আসার আগেই গত ২২ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের কাছে দুদক কমিশনের মহাপরিচালক (অর্থপাচার) আ ন ম আল ফিরোজ এক চিঠিতে বিভিন্ন দেশে পাচারকৃত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বাংলাদেশিদের তালিকা চান।

এমন ঘটনা জানাজানি হলে গত নভেম্বর থেকে কানাডায় পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করে বেলাল হোসেন সরকার। তবে ডিসেম্বর মাসের বরখাস্ত আদেশটি তাকে আরো চিন্তায় ফেলে দিলে এমন সিদ্ধান্ত নিতে তিনি আর সময়ক্ষেপন করেননি বলে সূত্র বলছে। 

তবে অন্য একটি সূত্র বলছে বেলাল কানাডায় নয় জনগণের রাজস্বের টাকা হরিলুট করায় ফৌজদারী মামলা ও গ্রেফতার এড়াতে তিনি দেশেই লুকিয়ে আছেন। নিজেকে সকলের কাছ থেকে আলাদা রেখে।

যেভাবে বেলাল হরিলুট করতো রেলের টাকা: ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভিন্ন স্টেশনের মালপত্র কেনাকাটায় এই সিওএস বেলাল সিন্ডিকেট চালিয়েছে হরিলুট। চলতি বছরের শুরুর দিকে পরিবহন অডিট অধিদপ্তর রেলওয়ের বিভিন্ন মাল কেনাকাটাসহ অন্যান্য বিষয়ে নিরীক্ষা করে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকশীর বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা ডিসিওর চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন স্টেশনে লেভেলক্রসিং গেটে ব্যবহারের জন্য তালা, বালতি, ঝাণ্ডা ও বাঁশি কেনা হয়েছে। এইসব মালামাল উচ্চমূল্যে ক্রয় করে জনগণের রাজস্বের ২৬ লক্ষ ৭৩ হাজার ৮৫০ টাকার আর্থিক ক্ষতি করেছে রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তারা। এমনকি এই দুর্নীতির সাথে জড়িত রয়েছে,  এই ক্রয় সংক্রান্ত বাজার যাচাই কমিটি, এস্টিমেট/প্রাক্কলন প্রণয়নকারী, এস্টিমেট অনুমোদনকারী, টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি ও টেন্ডার মূল্যায়নের সুপারিশ অনুমোদনকারী এবং তাঁদের আস্তাভাজন ঠিকাদার। 

রেলের মালামাল ক্রয়ে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার পরও অদৃশ্য ক্ষমতার বলয় ব্যাবহার করে স্বপদে বহাল তবিয়তে ছিলেন পূর্বাঞ্চল রেলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিওএস) বেলাল হোসেন সরকার, এসিওএস কন্ট্রোলার অব স্টোরস অফিস (পশ্চিম) মো. জাহিদ কাওছার ও বেলালের দুর্নীতির সাম্রাজ্যের অঘোষিত ক্যাশিয়ার উচ্চমান সহকারী নুরুল আমিন তালুকদার। পরে গত ২৯ ডিসেম্বর তাদের সাময়িক বরখাস্ত করে। 

জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেলের জন্য বিভিন্ন মালামাল কেনায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। নিরিক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখিত আছে মালামালের বাজার যাচাই, এস্টিমেট/প্রাক্কলন প্রণয়নকারী, টেন্ডার আহব্বান ও পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করাসহ সকল কার্যক্রম সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক সিওএস বেলাল হোসেন সরকার এর দপ্তরে হয়। এছাড়া ক্রয় প্রক্রিয়ায় কর্তব্যে অবহেলা, অদক্ষতা এবং আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতিতে সরাসরি সহায়তাকারী হিসেবে আরও ১৩ কর্মকর্তার নাম এসেছে।

এছাড়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় এই চক্রটি রেলওয়ে ঘুনটি ঘরে ব্যবহারের জন্য একটি তালা পাঁচ হাজার ৫৯০ টাকায়, প্রতিটি বালতি এক হাজার ৮৯০ টাকায়, প্রতি হুইসেল বাঁশি ৪১৫ টাকায় এবং হাত ঝাণ্ডা এক হাজার ৪৪০ টাকায় কিনেছেন। অথচ অডিট টিম বাজার ঝাচাই করে দেখতে পায়, একটি তালার বাজার মূল্য ১৫০ টাকা, বালতির বাজার মূল্য ৩০০ টাকা, একটি হুইসেল বাশিঁর বাজার মূল্য ৫০ টাকা এবং একটি হাত ঝান্ডার বাজার মূল্য ১৬০ টাকা। প্রতিটি পণ্যের উপর ৩০ % ভ্যাট, আইটি, সরবরাহকারী মুনাফা এবং আনুষঙ্গিক খরচ সহ প্রাক্কলিত মূল্য দাঁড়ায় তালা ১৬৫ টাকা, বালতি ৩৯০ টাকা, প্রতিটি বাঁশি ৬৫ টাকা, প্রতিটি হাত ঝান্ডা ২০৭ টাকা। উল্লেখিত মালামালের মধ্যে শুধু তালা বাজার মূল্যের ৩৩ গুন উচ্চমূল্যে ক্রয় করে সরকার তথা জনগণের রাজস্বের ১৮ লক্ষ ১৮ হাজার ৯০০ টাকা মেরে দিয়েছে চক্রটি। এভাবে বিভিন্ন কেনাকাটায় চাকরীজীবনে প্রকৌশলী বেলাল হোসেন সরকার প্রায় ২০০ কোটি টাকা অবৈধ ভাবে আয় করেছে বলে রেলওয়ের বিভিন্ন সূত্র বলছে। 

দুর্নীতি বিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, এইটা একটা যোগসাজসের দুর্নীতি। এই সব দুর্নীতি যারা বন্ধ করার দায়িত্বে আছেন তাদের একাংশ এই দুর্নীতির টাকায় লাভবান হয়।  ফলে এই সকল দুর্নীতিবাজদের তারা সুরক্ষা দেয়। 

আরও পড়ুন >>> রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সিওএস বেলাল বরখাস্ত হবে বলে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্যাসেঞ্জার ভয়েস