চট্টগ্রামের জানআলী হাট স্টেশনের সরেজমিন প্রতিবেদন

রেলের জায়গায় বস্তি বানিয়ে সালাম মাসে লাখ টাকা হাতাচ্ছে, তথ্য নেই রেলের কর্তাদের কাছে

Passenger Voice    |    ০৪:২১ পিএম, ২০২০-০৯-১৭


রেলের জায়গায় বস্তি বানিয়ে সালাম মাসে লাখ টাকা হাতাচ্ছে, তথ্য নেই রেলের কর্তাদের কাছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০১৭ তে রেলের বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে তার অধিক্ষেত্রের আওতায় রেলভূমিতে বিদ্যমান অবৈধ দখলদারদের বিধি মোতাবেক উচ্ছেদপূর্বক রেলভূমি বাংলাদেশ রেলওয়ে তথা সরকারের দখলে আনয়ন করতে হবে। উচ্ছেদ কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক, প্রধান প্রকৌশলী, মহাব্যবস্থাপক, রেলওয়ে পুলিশ ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। 

তবে রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে যায়, একটি স্টেশনের দায়িত্বে থাকা স্টেশন মাস্টার যদি নিজেই রেলের জায়গায় অবৈধ স্থাপনা করেন তাহলে এগুলো দেখার দায়িত্বও এই কর্মকর্তাদের। কিন্তু কে রাখে রেলের এইসব অসাধু স্টেশন মাস্টারদের অবৈধ দখলের খবর। 

প্যাসেঞ্জার ভয়েসের অনুসন্ধানে রেলের পূর্বাঞ্চলের জানআলী হাট স্টেশনের সরেজমিন প্রতিবেদন। 

নিবন্ধন নেই তবুও আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠন বাংলাদেশ রেলওয়ে ট্রাফিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ গঠন করে রাতারাতি নেতা বনে গেছেন চট্টগ্রামের জানআলী হাট স্টেশন মাস্টার আব্দুস সালাম ভুইয়া। নেতা বনে যাওয়ায় বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তাদের বিভিন্ন রকম ভয় ভিতি দেখিয়ে তিনি এই স্টেশনে বদলি হয়ে আসেন। শুরু করেন রেলের জায়গায় অবৈধ বস্তি নিমার্ণ। মাসিক মাসোয়ারা আদায়, কর্মচারীদের ডিউটি না করিয়ে কমিশন বাণিজ্য। তার সংগঠনটি দেশের কোথাও পরিচিত না হলেও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের পাহাড়তলি এলাকায় পরিচিত। এই সংগঠনের নাম দিয়ে বিভিন্ন তদবির বাণিজ্য, বদলী বাণিজ্য করে আব্দুস সালাম। 


স্টেশন মাস্টার গ্রেড -৩ এর এই কর্মকর্তার ক্ষমতার দাপটে রেল লাইনের উপর বসানো হয়েছে কাঁচা বাজার। দৈনিক তোলা হয় তার নামে চাঁদা। সুজন নামের এক ক্যাশিয়ার দিয়ে প্রতিদিন এমন কাজ করছেন তিনি। রেল লাইনের দুই পাশে ১০ ফুট করে ২০ ফুট এলাকায় সব সময় ১৪৪ ধারা জারি থাকলেও হরহামেশাই এ আইন ভাঙছেন কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ীরা, দোকান বসিয়েছে রেল লাইনের উপরে । এদিকে নেই কোনো ভ্রুক্ষেপ রেল কর্তৃপক্ষের। পুস্তক বা নথিতেই আইন সীমাবদ্ধ রাখায় এবং তার ন্যূনতম প্রয়োগও না থাকায় রেললাইনে কাঁচা বাজারের ব্যবসা খুব স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সূত্র বলছে, ১৮৬১ সালের ৫ নম্বর আইনের ১২ নম্বর ধারা মোতাবেক রেললাইনের দু’পাশে ১০ ফুট করে এলাকার মধ্যে রেলের কর্মী ছাড়া সাধারণ মানুষ কিংবা গবাদিপশুর প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ওই এলাকায় সব সময়ই ১৪৪ ধারা জারি থাকে। ওই সীমানার ভেতর কাউকে পাওয়া গেলে আইনের ১০১ ধারায় যে কাউকে গ্রেফতার করা যায়। কিন্তু উল্টো ঝামেলা পড়ার আশঙ্কাতেই রেলওয়ে পুলিশ এ আইনের প্রয়োগ করে না।


 

রেলের জমিতে দোকান ও বস্তি বানিয়ে মাসে লাখ টাকা যেভাবে হাতাচ্ছে:

জান আলী হাট স্টেশন এলাকায় সরকারি বাসা আছে আনুমানিক ৩০টি যার মধ্যে বরাদ্দ রয়েছে পাঁচটি । বাকিগুলো রেলের কিছু অসাধু কর্মচারীদের আতাত করে অবৈধ ভাবে ভাড়া নিয়েছে বহিরাগত মানুষ যা থেকে মাসোহারা পায় স্টেশন মাস্টার সহ আই ডাব্লিউ ষোলশহর। বিষয়টি নিয়ে আই ডাব্লিউ এর দায়িত্বে থাকা মো. ফারুক প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে জানান এই বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। স্টেশন মাস্টার বলতে পারবে। অথচ খবর নিয়ে জানা যায় এগুলো দেখবাল করার দায়িত্ব এই কর্মকর্তার। ঘুষের ভাগ পাওয়ায় তারা সাংবাদিকদের কাছে এই সব বিষয়ে কথা বলতে নারাজ।


কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে জান আলী হাট স্টেশনের দিকে গেলে চোখে পড়ে সারি সারি অবৈধ টিন শেডের ঘর ও দোকান। স্থানীয়দের দেয়া তথ্য বলছে স্টেশন মাস্টার আবদুস সালামকে প্রতি ঘর ও দোকান বাবদ মাসে এক থেকে দেড় হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। এছাড়া তিনি রেল লাইনের পাশে পুকুরের সাথে গড়েছেন এক বিশাল বস্তি যেখানে ৭০ থেকে ৮০ টি অবৈধ ঘর রয়েছে। প্রতি ঘর থেকে ১ থেকে দেড় হাজার করে মাসে লাখ টাকা চাঁদা উঠিয়ে থাকেন তিনি।

তবে জানআলী হাট স্টেশন মাস্টার আবদুস সালাম ভুইয়া প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, এই সব অবৈধ দখল আমি করিনি, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তারা এগুলো দখল করে।দখলকারীদের মধ্যে সাবেক মেয়রের লোকজন, চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহবায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চুসহ ছাত্রলীগ যুবলীগের নেতারা এগুলো করে। এদের কাছে শুধু আমি না, সিনিয়র কর্মকর্তারাও অসহায়। এছাড়াও তিনি সরকারি বাসা অবৈধ দখল হয়েছে বলে স্বিকার করেছেন।


এমনকি অভিযোগ আছে কাপ্তাই রাস্তার মাথায় গেট ঘরের সামনে এককালীন কিছু দোকান বিক্রিও করে দিয়েছে এই স্টেশন মাস্টার। নানান অপকর্মে জড়িত আব্দুস সালাম দুই বছর আগে জান আলী হাট স্টেশনে যোগদান দেওয়ার পর থেকে ট্রেন সিগন্যাল রেজিস্টারে (টিএসআর) অন ডিউটি অফ ডিউটি বিষয়ে কোনো স্বাক্ষর নেই বলেও তথ্য দিচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। 


 

সিনিয়র কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের নিয়ে আবদুস সালামের মন্তব্য:

স্টেশন এলাকায় লোকমূখে শুনা যায়, স্টেশন মাস্টার নিজেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে ট্রাফিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দাবি করে বিভিন্ন লোকজনকে বলে বেড়াই রেলের সিনিয়র কর্মকর্তাদের টাকা দিলে সব হয়। অবৈধ বস্তি ও বাজার বসিয়ে যে টাকা আয় হয় সেটা তো আমি একা খাইনা। সব অফিসারদের দিতে হয়। এছাড়া কতিপয় সাংবাদকর্মীদের নাকি সে টাকা দিয়ে থাকে এমন কথাবার্তা স্টেশন এলাকায় ছড়িয়েছে তিনি। আবার অনেকে অবৈধ বস্তি ও রেল লাইনে বাজার দেখে বিশ্বাসও করেন যে সালাম যদি উপরে টাকা পয়সা না দেয় তাহলে সিনিয়র কর্মকর্তারা  তার এই অর্পকর্মে বছরের পর বছর সায় দিত না। এছাড়াও আবদুস সালামকে সাম্প্রতিক সময়ে অফিস টাইমে বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা স্নেহাশিস দাশ গুপ্ত এর অফিসে ঘুড়াঘুড়ি করতে দেখা যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায় তিনি এই কর্মকর্তার কাছে বিভিন্ন তদবির নিয়ে বিভিন্ন সময় গিয়েছেন।


এছাড়াও এই কর্মকর্তা লাভলী বড়ুয়া, বকুল ও লোকমান নামের তিনজন গেইটম্যানকে ডিউটি না করিয়ে মাসিক ২৪ হাজার টাকার বিনিময়ে তাদেরকে ছুটি দিয়ে থাকেন। অনেকে মনে করে এইটা কিভাবে সম্ভব তবে সুধিজনরা বলছে ৫০ শতাংশ বেতন যদি স্টেশন মাস্টারকে দিয়ে তারা কাজে না এসে বেতন নিতে পারে সেটা গেইটম্যানদের লাভ। কারন তারা এই সময়ে অন্য জায়গায় কাজ করে আরো বেশি টাকা আয় করতে পারে। 

রেললাইনের উপর বাজার বসানো, লাইনের পাশে বস্তি তৈরি করার বিষয়ে অবগত নয় বলে প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেছেন রেলওয়ে ট্রাফিক বিভাগের র্শীষকর্তা ডিটিও স্নেহাশিস দাশ গুপ্ত। তিনি বলেন, এ ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকলে আমি যথাযথ ব্যবস্থা নিব।

এ বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সরদার সাহাদাত আলী প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ পেলে আমি বিষয়টি খবর নিয়ে দেখবো।