রেলের মালামাল ক্রয়ে দুর্নীতিতে জড়িত চট্টগ্রামের সিওপিএস শাহনেওয়াজ

Passenger Voice    |    ১২:০৭ পিএম, ২০২০-০৮-০৭


রেলের মালামাল ক্রয়ে দুর্নীতিতে জড়িত চট্টগ্রামের সিওপিএস শাহনেওয়াজ

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ আস্তাভাজন ঠিকাদার দিয়ে কাজ করানো, বিল দাখিল এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদার কর্তৃক বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাটসহ ডজন খানেক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের শীর্ষ কর্মকর্তা চীফ অপারেটিং সুপারিন্টেন্ডেন্ট মো. শাহনেওয়াজ এর বিরুদ্ধে। দুদক সরেজমিন তার কার্যালয় পরিদর্শন ও করেছিল। তবে পরিদর্শনের  আগে পেয়ে যায় পদোন্নতি। রেল সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে সখ্যতা আছে এমন তথ্য প্রকাশ করে নিজের ক্ষমতা জাহিরের চেষ্টাও করেন তিনি। অনেক সময় সিনিয়ম কর্মকর্তা কথারও গুরুত্ব দেননা এই শাহনেওয়াজ।

এদিকে রেলওয়ের জলাশয়-পুকুর ইজারা, যন্ত্রপাতি কেনাকাটা, নিলাম, টিকিট কালোবাজারি, জমি দখলসহ অনেক দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে। রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী বহিরাগত দালাল ও সিন্ডিকেটের সঙ্গে আঁতাত করে বছরের পর বছর রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগে এই দুর্নীতি করে যাচ্ছে।

দুদকের অনুসন্ধানে রেলওয়ের দুর্নীতির ১০টি উৎস চিহ্নিত করে এসব দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে ১৫টি সুপারিশ করা হয়েছে। গত বছরের ২ জুলাই ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের দুর্নীতি সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিমের পর্যবেক্ষণ’ প্রতিবেদনটি রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজনের কাছে হস্তান্তর করেন দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান।   

এমন প্রতিবেদন দেওয়ার অল্প সময় পরে দুর্নীতি দমন কমিশন রাজশাহী সমন্বিত জেলা কার্যালয় কর্তৃক পাওয়া গেল বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চীফ অপারেটিং সুপারিনটেন্ডেন্ট (সাবেক পশ্চিমাঞ্চলের চীফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার) মো. শাহনেওয়াজ নামের এই কর্মকর্তার দুর্নীতির তথ্য । 

দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্য়ালয়ের উপ-পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) বরাবরে রাজশাহী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. নাজমুল হুসাইন ও উপসহকারী পরিচালক আবুল বাসার চলতি বছরের ১৫ মার্চ (রাজশাহীর ই/এন নং-১০/২০২০) স্বারক মূলে এক এনফোর্সমেন্ট অভিযান প্রতিবেদনে মো. শাহনেওয়াজের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন।

দুদকের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী এর প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মো. শাহনেওয়াজের আস্তাবাজন ঠিকাদার দিয়ে কাজ করানো, বিল দাখিল এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদার কর্তৃক বিপুল পরিমান অর্থ লুটপাত সংক্রান্ত অভিযোগের উপর ভিক্তি করে দুদকের টিম সরেজমিনে পরিদর্শনকরে।

পরিদর্শনকালে এডিশনার চীফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার উম্মে সালমা ও ডেপুটি চীফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার আবদুল্লাহ আল মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারা জানায় প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকতার কার্যালয় থেকে চেয়ার. সোফা, এলইডি লাইট, বগি চিহ্নিত লাইট সরবরাহের জন্য সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (পশ্চিমাঞ্চল) বরাবরে চিঠি দেয়া হয়েছিল।  

তাদের দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে দুদকের টিম রাজশাহীর প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক বেলাল হোসেনের কার্যালয়ে গেলে তাকে কর্মস্থলে পাওয়া যায়নি তবে পাওয়া যায় সহকারী সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক জাহিদ কাওসারকে। জাহিদ কাওসারকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় এ সংক্রান্ত বিষয়ে তারা কোন কিছু জানেন না। এছাড়া তিনি দুদকের টিমকে নিশ্চিত করেছেন এ বিষয়ে টেন্ডার আহব্বান করা হয়নি। কোন ঠিকাদারকে কাজ দেয়া হয়নি এবং কোন বিল পরিশোধ করা হয়নি।

অথচ সরেজমিনে দুদকের এই টিম দেখে ৬৪ টি স্টীল চেয়ার, ১৩ টি সোফা, ১০ টি এলইডি লাইট, ৬৫ টি বগি চিহ্নিত লাইট রাজশাহী রেলষ্টেশনের সরবরাহ ও স্থাপন করা হয়েছে। তবে দুদকের কাছে এমন অভিযোগ স্বিকারও করেছেন এই শাহনেওয়াজ। তিনি বলেছেন স্টেশনে দ্রুততার সহিত সুসজ্জার জন্য আলমগীর ট্রেডার্স কে দিয়ে করিয়েছেন। তবে টেন্ডার ছাড়া এমন কাজ করার বিষয়টি তিনি স্বিকার করেছেন। এই প্রতিবেদনে দুদকের পক্ষ থেকে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহনের নিমিত্তে রেলপথ মন্ত্রনালয়কে পত্র প্রেরণ করেছে। 

তবে দুদকের অভিযানের বিষয়টি প্যাসেঞ্জার ভয়েসের কাছে স্বিকার করেছেন বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চীফ অপারেটিং সুপারিনটেন্ডেন্ট (সাবেক পশ্চিমাঞ্চলের চীফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার) মো. শাহনেওয়াজ। তবে এখন তিনি ভিন্ন সুরে কথা বলছেন। তিনি জানান, বনলতা ট্রেনে চালু করার সময় জিএম মহোদয় আমাকে স্টেশনটি সাজানোর দায়িত্ব দেয়। ফলে রেলের কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী মিলে এই জিনিসগুলো উপহার হিসেবে দিয়েছেন। তবে উপহার হস্তান্তরের কোন তথ্য তিনি প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে দিতে পারেনি। তবে দুদকে তিনি বলেছেন মালামালগুলো আলমগীর ট্রেডার্স নামের এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়েছেন। তবে কোন স্বার্থে টাকাছাড়া কয়েকলক্ষ টাকার মালামাল উপহার দিয়েছে এমন প্রশ্নে  তিনি খোলাসা করে কিছু বলতে পারেনি। তবে তিনি বারবার বলছিলেন এই কেনাকাটায় সরকারের কোন টাকা খরচ হয়নি। ফলে বিষয়টি নিয়ে রহস্যই থেকে গেল।

এদিকে এই অভিযোগ পাওয়ার পরে রেলপথ মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে দুদকের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য এই মন্ত্রনালয়ের ২৭ জুলাইয়ের ৫৪.০০.০০০০.০০০.১৮.০১৭.১৮.২২ নং স্বারকমূলে উপসচিব সালমা পারভীন স্বাক্ষরিত এক পত্রে অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবিরকে  তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। 

শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে দুদকের অভিযোগ তদন্তের জন্য কমিটি গঠনের বিষয়টি প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে নিশ্চিত করেছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (প্রশাসন-৩) বেগম সালমা পারভীন।

এদিকে রেলের একটি সূত্র বলছে, করোনার মহামারীতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে এক অফিস আদেশে ৪৫ পয়েন্টসম্যান নিয়োগের ঘটনাও ঘটিয়েছেন তিনি। নিজের পছন্দের লোকজনকে চাকরী দিতে কোন বিজ্ঞপ্তি ছাড়া এই নিয়োগটি করেছিলেন তিনি । চলতি বছরের ১৮ মে  নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করলে দেখা যায় মো. রুবেল, মো. শরিফুল ইসলাম, সরোয়ার গাজী, সোহাগ, আবদুল হাই, সোহেল, রুমান ও ইমরান হোসেন নামের ৮ জন পয়েন্টসম্যানের চাকরীর জন্য তদবির করেছে চট্টগ্রামের এই সিওপিএস মো. শাহনেওয়াজ।

অভিযোগ রয়েছে এই ব্যক্তিদের কাছ থেকে তিনি আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। তবে চাকরী হারানোর ভয়ে এদের কেউ এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে নারাজ।

এছাড়াও করোনাকালে রেলওয়ের জন্য পিপিই, গ্লাভস, হ্যান্ড সেনিটাইজারসহ কোটি টাকার পণ্য ক্রয়ে বিপুল পরিমান অনিয়ম করেছে এই কর্মকর্তা। যা নিয়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে রেলের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাঝে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক একটি গণমাধ্যমে বলেছেন  উন্নত বিশ্ব ছাড়াও আশপাশের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ট্রেনের গতি সবচেয়ে কম। রেলে রক্ষণাবেক্ষণে ব্যক্তিগত প্রাপ্তি নেই, প্রকল্পে সেটা আছে। তাই বড় প্রকল্পে মনোযোগ বেশি। রক্ষণাবেক্ষণে দরদি লোক দরকার। নিয়োগে রাজনৈতিকীকরণ এবং ঘুষ-কমিশনের কারণে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না।

সামছুল হক বলেন, নিরবচ্ছিন্ন গতি ও নিরাপদ যাতায়াতের জন্য রেল সারা বিশ্বেই নির্ভরশীল সেবা। গতি বাড়ানো গেলে বর্তমানে যে সম্পদ আছে, তা দিয়েই যাত্রীসেবা পরিবহন ও সেবা কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব। শুধু কেনাকাটায় টাকা খরচ না করে তাই রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগ দেওয়া উচিত।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমি ২৭ তারিখ থেকে ছুটিতে আছি। আদেশের কপিটি এখনও হাতে পায়নি। তবে পশ্চিমাঞ্চলের কেনাকাটার কিছু অনিয়ম সম্পর্কে আমি এর আগে জেনেছি। আমি জয়েন্ট করে এই বিষয়টি দেখবো।

সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, রেলে দুর্নীতি নেই এটা বলব না। তবে আমাদের সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহন করেছে। আমরা সেই নীতিতে অব্যাহতভাবে আমাদের কাজ করে যাব। আপনাকে একটা জিনিস কিনতে দিলাম আপনি ১০ টাকার জিনিস ৫০ টাকায় কিনেছেন। এ রকম সুনিদিষ্ট দুর্নীতির তথ্য যদি আপনারা (সাংবাদিকরা) দিতে পারেন তাহলে আমরা খুশি হব। এভাবে দুর্নীতি হচ্ছে বা অমুক জায়গায় দুর্নীতি হয়েছে এ রকম তথ্য দিতে পারলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নিব। এর সাথে যে বা যারাই জড়িত থাকুক, যত বড় শক্তি দুর্নীতি করুক আমরা ব্যবস্থা নিব।