তদন্ত কমিটির সুপারিশের শেষ নেই, বাস্তবায়ন ‘শূন্য’

বিআরটিএর হিমাগারে ওয়াজেদ-খাবীরুর স্লিপার বাস জালিয়াতির ফাইল

Passenger Voice    |    ১২:৩০ পিএম, ২০২৫-১১-০৩


বিআরটিএর হিমাগারে ওয়াজেদ-খাবীরুর স্লিপার বাস জালিয়াতির ফাইল

সামসুদ্দীন চৌধুরীঃ সড়কে স্লিপার বাস চাপায় মরছে মানুষ, ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত কর্তৃপক্ষ। গণমাধ্যম দুর্নীতিবাজদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করলে দায়সারা তদন্ত করে বিআরটিএ। পরে প্রশাসন শাখার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা জালিয়াতিতে জড়িত সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) মোটরযান পরিদর্শকদের কাছ থেকে মোটাদাগে ঘুষ নিয়ে তদন্তের নথী গায়েব করে দেয়। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর “চ্যাসিস বিক্রি বডি তৈরীর আগে ময়মনসিংহ বিআরটিএতে ঘুষে মেলে স্লিপার বাসের নিবন্ধন” শিরোনামে বিআরটিএ ময়মনসিংহ সার্কেলে জুলাই-অক্টোবর ২০২৪ সময়কালে কর্মরত সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) এস এম ওয়াজেদ হোসেন এবং মোটরযান পরিদর্শক আব্দুর খাবীরু এর বিরুদ্ধে জালিয়াতির প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্যাসেঞ্জার ভয়েস। 

প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিআরটিএ ২০২৪ সালের ১২ ডিসেম্বর স্বারক নং-৩৫.০৩.০০০০.০০৪.৯৯.০০৪.২২-৮৫১ স্মারকের আদেশে এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা বিআরটিএর সদর কার্যালয়ের উপপরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং-) তৌহিদুল ইসলাম তুষার গত ২৬ জানুয়ারী তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন বলে প্যাসেঞ্জার ভয়েস নিশ্চিত হয়েছে। তবে বিআরটিএর প্রশাসন শাখার কতিপয় কর্মকর্তা মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনটি গায়েব করে দেন বলে অনুসন্ধানে জানা যায়।

সূত্র বলছে, ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে বিআরটিএর প্রধান সহকারী পদে কর্মরত মামুনকে পদ থেকে সরিয়ে অফিস সহকারী আজহারুল ইসলামকে প্রধান সহকারীর দায়িত্ব প্রদান করে বিআরটিএর সাবেক চেয়ারম্যান। আজহারুল ইসলাম দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে বিআরটিএতে নথি গোপনের বিষয়গুলো শুরু হয়েছে। জানুয়ারী মাসে প্রদান করা ময়মনসিংহ সার্কেলের জালিয়াতির তদন্ত রিপোর্ট এস এম ওয়াজেদ হোসেন আব্দুল খাবীরুর কাছ থেকে সময়ে সময়ে বিভিন্ন অঙ্কের ঘুষ নিয়ে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১০ মাস ফাইলটি হিমাগারে লুকিয়ে রাখেন। বিআরটিএর বর্তমান চেয়ারম্যান তথ্যটি না জানায় এইসব দুর্নীতিবাজরা এখনও বিভিন্ন সার্কেলে বহাল তবিয়তে ঘুষ বাণিজ্য চালাচ্ছে। 

প্যাসেঞ্জার ভয়েসের অনুসন্ধান বলছে, বিআরটিএ ময়মনসিংহ সার্কেলের নিবন্ধন দেওয়া অবৈধ ৩৫ টি স্লিপার বাস থেকে প্রায় কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিল তৎকালীন ময়মনসিংহ সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) এস এম ওয়াজেদ হোসেন (বর্তমানে যশোর সার্কেলে) এবং মোটরযান পরিদর্শক আব্দুর খাবীরু (বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সার্কেলে) সেই ৩৫ টি বাসের মধ্যে ৩৩ টি বাস অশোক লেল্যান্ড ব্রান্ডের। ০২ টি বাস হাইগার বাস কোম্পানী লিঃ চায়নার। 

প্যাসেঞ্জার ভয়েসের হাতে আসা গাড়ি গুলোর আমদানিকৃত কাগজ যাচাই করে দেখা যায় অশোক লেল্যান্ড ব্যান্ডের মডেল ১২ এম যা ২০১৭ সালের ০৪ জুলাই বিআরটিএর সদর কার্যালয় হতে ৪১ আসন বিশিষ্ট বাস হিসেবে টাইপ ড্রইং অনুমোদন গ্রহণ করেন আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান ইফাদ অটোস্ লিমিটেড। তবে রহস্যজনক ভাবে দেখা যায় হাইগার বাস কোম্পানী লিঃ চায়না এর বিপরীতে বিআরটিএ কোন টাইপ অনুমোদন ইস্যু করেনি।

সূত্র বলছে, ২০১৭ সালের ০৪ জুলাই স্মারক নং- ৩৫.০৩.০০০০.৩১.০০৬ (অংশ-২)২০১৭-২১৪২ স্বারকে Ashok Leyland ব্যান্ডের ১২ M মডেলের বাস ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট) গাজিপুর এর সুপারিশ, ইমিশন টেষ্ট রিপোর্ট, আমদানি সংক্রান্ত কাগজপত্র এবং বিআরটিএর স্থায়ী টেকনিক্যাল কমিটির ২০১৭ সালের ১৩ জুন তারিখের অনুষ্ঠিত সভার সুপারিশ পর্যালোচনাক্রমে বডি তৈরিকৃত Ashok Leyland ব্যান্ডের  ১২ M মডেলের বাসের প্রচলিত বিধি বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ পূবর্ক সর্বোচ্চ উচ্চতা -৩৫৫০ এম এম। প্যাসেঞ্জার আসন সাইজ ও সংখ্যা (চালকসহ) 925mm x 534mm (2p x 10s) 20p, 925mm x 534mm (2p x 10s) 20p, 508mm x 460mm, (1d x 1s).  01d total-41 persons. সিটের দুরত্ব (ব্যাক টু ফ্রন্ট) 805mm. খালি গাড়ির ওজন ১০৬৫০ কেজি (চ্যাসিস ও বডি)। সর্বোচ্চ ওজন (পে-লোডসহ) ১৬২০০ কেজি। তবে নিবন্ধন দেওয়া গাড়িগুলোর তৈরি সন ২০২২, ২০২৩, ২০২৪ সাল।

এই পর্যন্ত সব ঠিক থাকলেও বিপত্তি বাঁধে ২০২২ সালের ২৬ মে নং-৩৫.০৩.০০০০.০০৩.৩১.০২০.২১-৫৮৫ সংক্ষক স্মারকে বিআরটিএর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) এর নির্দেশনা । উক্ত আদেশে বিআরটিএ সকল সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ)গণকে নির্দেশনা দিয়েছেন যে, CHASSIS FITTED WITH ENGINE IN CBU, CHASSIS IN COMPLETE BUILT UP UNIT (CBU) প্রভৃতি অবস্থায় আমদানীকৃত নতুন বাসসমূহের বিষয়ে রেজিষ্ট্রেশনের পূর্বে বিআরটিএ সদর কার্যালয়ের টাইপ অনুমোদন শাখা হতে পুর্বানুমতি গ্রহণ আবশ্যক। উক্ত নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ময়মনসিংহ সার্কেলে এই সব স্লিপার বাসেন নিবন্ধন দিয়েছে সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) এস এম ওয়াজেদ হোসেন এবং মোটরযান পরিদর্শক আব্দুর খাবীরু। এছাড়াও ময়মনসিংহ-ব-১১-০২৬৫, ময়মনসিংহ-ব-১১-০২৬৮ নাম্বারে রেজিষ্ট্রেশন প্রদান করা হাইগার বাস কোম্পানী লিঃ চায়না এই বাসগুলোর বিপরীতে বিআরটিএ কোনো ধরণের টাইপ অনুমোদন , আসন বিন্যাস বা ড্রইং প্রদান করেনি। বিআরটিএর টাইপ অনুমোদন ব্যতিত জালিয়াতির মাধ্যমে স্লিপার বাসের নিবন্ধন প্রদান করে সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) এস এম ওয়াজেদ হোসেন এবং মোটরযান পরিদর্শক আব্দুর খাবীরু সড়ক পরিবহন বিধিমালা -২০২২ এর ৩৪(৭)(গ) বিধি, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ধারা-১৯(১) এর বিধান ও ২০২৩ সালের ৫ জুন জারিকৃত সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আদেশ লঙ্ঘন করেছেন।

Ashok Leyland ব্যান্ডের বাস গুলোর BILL OF ENTRY/EXPORT কপিতে HS CODE উল্লেখ করা হয়েছে 8706.00.22 । DESCRIPTION OF GOODS এ বলা হচ্ছে CHASSIS FITTED WITH ENG.HEADING NO87.02 BUSES FOR HAVING SEATING CAP.ASH: LEY: 12M BUS CHA.6200 MM.5759 CC.225 HP IN CBU উল্লেখ আছে। বাস সমূহের আমদানী সংক্রান্ত কাস্টমস এর বিল অন এন্ট্রিতে উল্লিখিত HS CODE 8706.00.22 CBU অবস্থায় আমদানী উল্লেখ না থাকলেও উক্ত বাস গুলোকে CBU  অবস্থায় আমদানী হিসেবে রেজিষ্ট্রেশন প্রদান করা হয়েছে।  HS CODE 8706.00.22 টি BUSES FOR HAVING SEATING CAPACITY OF 40 OR MORE নিবন্ধিত আসন সংখ্যা থেকে কমিয়ে বাস গুলোর নিবন্ধ প্রদান করেছে এই দুই কর্মকর্তা।

অন্যদিকে মোটরযানের নিবন্ধন প্রদানে ও ফিটনেস সনদ নবায়ন ও ইস্যু করার সময় মোটরযান পরিদর্শক কর্তৃক মোটরযানের সামনে ছবি উঠানোর বিধান রয়েছে। তবে এই বাসগুলো নিবন্ধন প্রদানের সময় কোন গাড়ী পরিদর্শন করেনি মোটরযান পরিদর্শক আব্দুর খাবীরু। তবে পরবর্তীতে অন্য বাসের ছবি বিভিন্ন বাস টার্মিনালে ও রাস্তায় উঠিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বোকা বানিয়েছেন। সড়ক পরিবহন বিধিমালা -২০২২ এর বিধি-৩৪ এর উপধারা ৬ এর (খ), (গ), ও (ঘ) ধারা লঙ্ঘন করে রেজিষ্ট্রেশন প্রদানের সুপারিশ করেছে এই মোটরযান পরিদর্শক। এছাড়াও ২০১৮ সালের ২২ মে স্বারক নং-৩৫.০৩.০০০০.০০৪.৩১.০০৩.১৮-৩৬ এবং ২০২০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বারক নং-৩৫.০৩.০০০০.০০৩.৩১.০২১.১৮ (পার্ট-৩)-১০০২ সংক্ষক বিআরটিএর চেয়ারম্যানের আদেশ ও সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এ ২০(১) (ক) ও (ঘ) সম্পূর্ণভাবে অমান্য করেছেন বলে প্যাসেঞ্জার ভয়েস নিশ্চিত হয়েছে।

বিআরটিএর প্রশাসন শাখাকে কেন ঘুষ দিতে হচ্ছেঃ স্লিপার বাস নিবন্ধনে বিআরটিএর এই দুই কর্মকর্তা ৩ প্রক্রিয়ায় জাল-জালিয়াতি করেছেন। এইসব জাল জালিয়াতির কারণে সরকারি  চাকরি বিধিমালায় এই সব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জন্য ৪ ধরনের সাজার কথা উল্লেখ রয়েছে। 1। Reduction to a lower post or time scale. 2. Compulsory retirement 3. Removal from service. 4. Dismissal from service.

বিআরটিএর বর্তমান চেয়ারম্যান আবু মমতাজ মোহাম্মদ সাদ উদ্দিন আহম্মেদ একজন সৎ এবং নিষ্ঠাবান ব্যাক্তিত্ব হওয়ায় তিনি এই ধরণের জালিয়াতিকারীকে কোন ছাড় দিবেন না মর্মে অবগত থাকায় তারা ফাইলটি হিমাগারে লুকিয়ে রাখার জন্য মোটাদাগে টাকা ছিটাচ্ছে।

এদিকে জালিয়াতিতে পিছিয়ে নেই ময়মনসিংহ সার্কেলে কর্মরত বিএমটিএফ এর কর্মচারী এনরোলমেন্ট এক্সিকিউটিভ শরিফুল ইসলাম রনি।  তিনিও মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে বিআরটিএ স্টেশনের বাহিরে বিভিন্ন জায়গায় বিআরটিএর সরঞ্জাম নিয়ে গিয়ে ময়মনসিংহ-ব-১১-০২৫৬, ময়মনসিংহ-ব-১১-০২৭৫, ময়মনসিংহ-ব-১১-০২৮০, ময়মনসিংহ-ব-১১-০২৯০, ময়মনসিংহ-ব-১১-০২৯৩, ময়মনসিংহ-ব-১১-০২৯৮ নং বাসের ডিজিটাল নাম্বার প্লেট সংযোজন করেছেন।