অর্ধকোটি টাকার ঘুষ লেনদেন, করোনার সময়ে ৪৫ পয়েন্টসম্যান নিয়োগ রেলে

Yasin Hoque    |    ১১:০৫ এএম, ২০২০-০৬-২৮


অর্ধকোটি টাকার ঘুষ লেনদেন, করোনার সময়ে ৪৫ পয়েন্টসম্যান নিয়োগ রেলে

ইয়াছিন হকঃ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আদেশকে তোয়াক্কা না করে করোনা মহামারির মধ্যে সাধারণ ছুটি চলাকালীন অবস্থায় অর্ধকোটি টাকার নিয়োগ বানিজ্য হওয়ার অভিযোগ রেল অঙ্গনে। নিয়োগবিধিকে বৃদ্ধাআঙুল দেখিয়ে সাধারণ ছুটির মধ্যে নিয়োগ দেয়া হয় ৪৫ জন পয়েন্টসম্যান। ব্যাস্ততম মেইন লাইনে না দিয়ে ৪৫ প্রার্থীর মধ্যে ৩০ জন কে পদায়িত করা হয়েছে শাখা লাইনে , যেখানে ট্রেন চলাচল সীমিত । অভিযোগ আছে রেলের স্বার্থবিরোধী এই নিয়োগে হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেনের মাধ্যমে। ঘুষ লেনদেনের অভিযোগের তীর বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (ডিটিও) ওমর ফারুকের দিকে।

২০১৯ সালের শেষের দিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় ১৯৮৫ সালের নিয়োগবিধি বাতিল করে বলেন, এই আইনের অধীনে রেলওয়েতে কোনো নিয়োগ দেয়া যাবেনা । ফলে রেলওয়ের সব নিয়োগ বন্ধ হয় । কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক, বন্ধ স্টেশন পুনরায় চালু করার দোহায় দিয়ে ' অস্থায়ী ' ভাবে পয়েন্টসম্যান নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রেলওয়ে । এর পর থেকেই রেল অঙ্গনে আবারো রেলের নিয়োগ বাণিজ্যের দালালদের আনাগোনা শুরু হয়। গত মার্চ মাসের দিকে যখন দেশে করোনা সংক্রমন শুরু হওয়ায় সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষনা করে সব অফিস বন্ধ রাখে। ঠিক তখনই লকডাউনের আড়ালে রেলের কিছু অসাধু কর্মকর্তারা মেতে উঠেন এই নিয়োগ বাণিজ্যের খেলায় । পয়েন্টসম্যানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে  কোনরকম যাচাই বাছাই ছাড়া রহস্যজনক এক প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয় ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের এক কর্মকর্তা বলেন পি-মেন (পয়েন্টসম্যান)  একটি তৃতীয় শ্রেণীর পদ । নিয়োগবিধি কার্যকর থাকলেও  সরাসরি এই পদে নিয়োগ দেয়া যায় না । তিনি  বলেন নিয়োগবিধি  অনুযায়ী, রেলওয়ের ট্রাফিক বিভাগে গেটকিপার, পোর্টার, সিলম্যান ও ওয়েটিংরুম বেয়ারাসহ অন্যান্য পদে ন্যূনতম তিন বছর কর্মরতদের মধ্য থেকে পয়েন্টসম্যান নিয়োগ দিতে হয়। সেই জায়গায় নিয়োগবিধি বাতিল হওয়া সত্বেও কিভাবে সরাসরি তাদের পয়েন্টসম্যান পদে নেওয়া হয় এটাই তো এখন আলোচনার বিষয়।

সূত্র অনুযায়ী প্রত্যেক নিয়োগ প্রার্থীর কাছ থেকে ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ' ঘুষ ' লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। তবে চাকরি হারানোর ভয়ে এই বিষয়ে সরাসরি কেউ মূখ খুলতে নারাজ। তবুও প্যাসেঞ্জার ভয়েসের অনুসন্ধানে উঠে আসে অর্ধকোটি টাকা ঘুষ লেনদেনের বিনিময়ে পয়েন্টসম্যানদের নিয়োগ দেওয়া ও শাখা লাইনে পদায়িত করা হয়। অনুসন্ধানে এই প্রতিবেদকের হাতে আসা কিছু নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায় চট্টগ্রামে মোট ৪৫ জন পি-মেনের মধ্যে ৩০ জনকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে শাখা লাইনে । এদের মধ্যে পলাশ চন্দ্র দে পিতা উপলাল দে নিয়োগ পায় শাখা লাইন চাঁদপুরে , জাহাঙ্গীর আলম পিতা জালাল আহমেদের নিয়োগ হয় চিতোশি রোড । আবদুল্লাহর ছেলে হালিমের নিয়োগ হয় কাঞ্চননগর। মামুন খান পিতা আব্দুল খালেক খান নিয়োগ পায় ঝাউতলা । মৃত জাকির হোসেনের ছেলে শওকত হোসেন নিয়োগ পায় হাটহাজারী । আবদুল বাতেন এর ছেলে আকবর হোসেনের নিয়োগ হয় নাজিরহাট প্রমুকসহ ২৪ জন প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয় শাখা লাইনে । নথিতে আরো কয়েকজনের নামের পাশে কর্মস্থলের কলামে লেখা আছে ' রিলিভিং ' । সূত্র বলছে, এদেরকেও শাখা লাইনে দিয়ে মোটা অংকের অর্থ আদায় করা হবে ।

রেলের নিয়োগ দুর্নীতি নতুন নয়ঃ
ট্রেন চলাচল নির্বিঘ্ন করতে অতি জরুরি কর্মী পয়েন্টসম্যান। স্টেশন ছাড়ার আগে ট্রেনচালকের কাছে ট্র্যাক ও অন্যান্য বিষয়ে স্টেশনমাস্টারের নির্দেশনা পৌঁছে দেন পয়েন্টসম্যান। কোথাও কোথাও রেল ট্র্যাক পরিবর্তনের কাজটিও করেন পয়েন্টসম্যান। এটা সত্যি যে রেলের জনবল সংকটের কারণে রেল চলাচল স্বাভাবিক রাখতে কিছু পয়েন্টসম্যান দরকার । তবে তা মেইন লাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম এর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। প্রায় ৩ ডজন পয়েন্টসম্যান নিয়োগ দেয়া হয়েছে শাখা লাইনগুলোতে যেখানে সারাদিন দুই একটা ট্রেনের অধিক যায় না । ফলে প্রশ্ন উঠেই এই নিয়োগে রেলের কি স্বার্থ হলো ? এখানে ব্যাক্তিগত স্বার্থ রক্ষা হতে পারে কিন্তু এটা রেলের স্বার্থের পরিপন্থী । তাছাড়া পি-মেনদের প্রশিক্ষণের বিষয় আছে, এভাবে অদক্ষ লোক নিয়োগ দিয়ে রেলপথে যাত্রীদের ঝুঁকিতে ফেলানো ছাড়া আর কিছুই নয় বলে বিশ্লেষকরা জানান ।   

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ অপারেটিং সুপারিটেনডেন্ট  (সিওপিএস) এ এস এম  শাহনেওয়াজ প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, 'আমার কাছে এই বিষয়ে লিখিত কোনো অভিযোগ আসলে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নিবো।' তিনি আরো বলেন, 'পয়েন্টসম্যান গুরুত্বপূর্ন পোষ্ট হলেও নিয়োগের আগে তাদের দক্ষতা যাচাই করার কোনো প্রক্রিয়া নেই । কোন প্রক্রিয়ায় তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে ডি টি ও ভালো বলতে পারবে।

বিষয়টি জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (ডিটিও) ওমর ফারুকের কাছে গেলে তিনি নিজের অনিয়ম ও নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগগুলো শুনে চেয়ার থেকে উঠে কোনো উত্তর না দিয়েই অফিস কক্ষ ত্যাগ করেন। তবে তার অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই ঘুষ লেনদেন ও ওমর ফারুকের অনিয়ম দুর্ণীতির কথা স্বীকার করেন।

এ বিষয়ে রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সরদার শাহাদাত আলি প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমি বিষয়টি নিয়ে অবগত না। আপনার (সাংবাদিক) মাধ্যমে জেনেছি । যেহেতু অর্ডার ইস্যু করেছে ডিটিও, যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে ডিআরএম , সিওপিএস ব্যবস্থা নিবে । যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তখন আমি বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখবো ।