বিআরটিএর ক্ষমতাধর মোটরযান পরিদর্শক মো. মহসিন

দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি থানায় আটক, ঘুষ নিয়ে ফিটনেস দিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিআরটিএ

Passenger Voice    |    ০৩:৫৫ পিএম, ২০২৪-০৯-০৩


দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি থানায় আটক, ঘুষ নিয়ে ফিটনেস দিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিআরটিএ

নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২১ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ’তে মোটরযান পরিদর্শক পদে যোগদান করেন মো. মহসিন। বর্তমানে এই কর্মকর্তা বিআরটিএর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সার্কেলে কর্মরত আছেন। চাকরিতে যোগদানের পর থেকে অবৈধ টাকা আয়ের জন্য  মরিয়া হয়ে অপকর্ম চালাচ্ছে বিআরটিএ’র এই সার্কেল অফিসে। এই সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি:) আশরাফ সিদ্দিকি মান্নান বিআরটিএর শীর্ষ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হওয়ায় মোটরযান পরিদর্শকের সব কাজে সহযোগিতা করেন তিনি। মাত্র ১০ হাজার টাকা করে ঘুষ প্রদান করলে এই মোটরযান পরিদর্শক যে কোন গাড়ী পরিদর্শন ছাড়ায় ফিটনেস সনদ ইস্যু করে দেন। মহসিনের কাছে বিআরটিএ যেন ঘুষের টাকা কামানোর এক মেশিন। 

ঘুষের টাকা পেলে কোন গাড়ির কি হয়েছে,  কোন গাড়ি দুর্ঘটনায় কত মানুষ মারা গেল কোন কিছুই যেন এই মোটরযান পরিদর্শক এর বুকে নাড়া দেয় না। এর আগে ঘুষের বিনিময়ে আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনায় মায়ের পেট থেকে বাচ্চা বের হয়ে যাওয়া গাড়িও টাকার বিনিময়ে ফিটনেস দিয়েছিল বিআরটিএ। এছাড়াও ডাকাতির মামলায় আটককৃত গাড়িও ঘুষের বিনিময়ে ফিটনেস দিয়েছিল বিআরটিএ এমন নজিরও রয়েছে।  তবে বিআরটিএ চেয়ারম্যানগণ সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলার মাধ্যমে এইসব দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দিয়ে চলছে ফলে বিআরটিএ’র এই ধরনের দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। 

গত ০৭ জুলাই রাতে কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম জগমোহনপুর এলাকায় ঢাকা মেট্রো- ট-১৪-৭৮৫৮ নং গাড়ির চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী প্রসাদ কর্মকার সুমন (৪০) ও কাজী বাপ্পি নামের দুই  আহত ব্যক্তিকে মিয়া বাজার হাইওয়ে থানা পুলিশ তাদের উদ্ধার করে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার সুমনকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। একই সাথে কাজী বাপ্পিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কুমিল্লা সদর হাসপাতালে প্রেরণ করেন। গত ৩ দিন আগে কাজী বাপ্পি হাসপাতালে মারা যায়। এই ঘটনায় প্রসাদ কর্মকার সুমন এর স্ত্রী বাংলাদেশ পুলিশের চৌদ্দগ্রাম থানার এএসআই মিঠু রানী পাল ০৮ জুলাই চৌদ্দগ্রাম থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।

এদিকে বিআরটিএ বলছে এই গাড়িটির যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন গাড়িটির ফিটনেস সনদ এর মেয়াদ ছিল না। ২০২৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী ঢাকা মেট্রো-ট-১৪-৭৮৫৮ নং গাড়িটি ফিটনেস সনদ ইস্যু করে বিআরটিএ’র ঢাকা মেট্রো-২ সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক মো. রুহুল আমিন।  এই ফিটনেস সনদের মেয়াদ চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারী শেষ হয়ে যায়। ০৭ জুলাই যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন গাড়িটির ফিটনেস সনদের মেয়াদ ছিল না। প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আজ ৩ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫ টা পর্যন্ত গাড়িটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিয়াবাজার হাইওয়ে থানায় আটক রয়েছে।  তবে গাড়িটি গত ২১ আগষ্ট পরিদর্শন না করে ১০ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণ করে অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র জনতার আন্দোলনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই গাড়িটির ফিটনেস প্রদান করেন।  যা দেখে হতবাক হাইওয়ে থানার পুলিশ।  

বিআরটিএর সদর কার্যালয়ের তথ্য বলছে ২১ আগষ্ট মোটরযান পরিদর্শক মো: মহসিন ৬০ টি মোটরযান এর ফিটনেস প্রদান করেন।  তারমধ্যে ৩০ টি প্রাইভেট গাড়ি আর ৩০ টি বার্ণিজিক গাড়ি। তবে ঢাকা মহানগরীতে রেজিষ্ট্রেশন পাওয়া ৪০ এর অধিক গাড়ি বিআরটিএর এই সার্কেলে কিভাবে গেল সেটাও তদন্ত করার দাবি অনেক মোটরযান পরিদর্শকের।

এমন অপকর্মের পরেও মো: মহসিন এর ধারণা বিআরটিএ’তে সকল অনিয়ম কে নিয়ম বানানো যায়। সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলা হলেও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে চেয়ারম্যান,  সচিব ও অনান্য কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে পার পাওয়া যায়। গণমাধ্যমের কোন নিউজ বিআরটিএ’তে কোন পরিবর্তন করতে পারবে না।  টাকা দিলে সব অপরাধ থেকে মুক্তি মেলে। 

এই কর্মকর্তার কাছে বিআরটিএর চেয়ারম্যান এর আদেশের তোয়াক্কা নেই টাকার বিনিময়ে পরীক্ষা না নিয়েও ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করেন এই কর্মকর্তা।  ঘুষের বিনিময়ে ভাঙ্গাচোরা লক্কর ঝক্কর মোটরযানের ফিটনেস দিচ্ছে একদিকে, অন্যদিকে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ২০ (১)(ক) ধারা অনুযায়ী মোটরযান রেজিষ্ট্রেশন ও ফিটনেস প্রদানকালে মোটরযানের সাথে মোটরযান পরিদর্শকের স্থিরচিত্র ধারণ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানছে না মোটরযান পরিদর্শক মো. মহসিন ।

উল্লেখ্য, এর আগে ২০২৩ সালের ১৫ মার্চ কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানার এসআই (নিরস্ত্র) ফেরদৌস হোসেন এর নেতৃত্বে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে একটি পিকআপ গাড়ি সহ ডাকাত দলকে আটক করে পুলিশ। পরে একই দিন সন্ধ্যায় পেনাল কোর্ট তৎসহ ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনের ১৯(f) এর  ৩৯৯/৪০২ ধারা মতে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়। মামলা নং-১৯। মামলাটি কুমিল্লার আমলী আদালত নং-৯ এর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট এর আদালতে বিচারাধীন । ওই গাড়িটি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানায় জব্দ থাকা অবস্থায় টাকার বিনিময়ে ফিটনেস সনদ ইস্যু করেছে মোটরযান পরিদর্শক প্রণব চন্দ্র নাগ। এই ঘটনায় প্যাসেঞ্জার ভয়েস প্রতিবেদন প্রকাশ করলে এই মোটরযান পরিদর্শককে কর্তৃপক্ষ বরখাস্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়।

এর আগে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশাল উপজেলার কোর্ট ভবন এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাকচাপায় পরে মায়ের পেট ফেটে শিশুর জন্ম হওয়ার ঘটনায় জব্দ সেই ট্রাককেও ফিটনেস সনদ দিয়েছিল বিআরটিএ। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ধারা ২০ এবং বিআরটিএ কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে জারি করা সরকারি আদেশ অমান্য করে ঢাকা মেট্রো ট-২০-৩৫৮০ নম্বর মোটরযান পরিদর্শন না করেই ফিটনেস সনদ ইস্যু এবং অসদাচরণের অভিযোগে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ৩৯(১) অনুযায়ী বিআরটিএ নারায়ণগঞ্জ সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক নূর মোহাম্মদ তোয়াহাকে ২০২২ সালের ২৩ জুলাই সাময়িক বরখাস্ত করে সদর কার্যালয়ে ক্লোজ করেন তৎকালীন বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার । এই কর্মকর্তার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে তাকে শাস্তি প্রদান করে কর্তৃপক্ষ। শাস্তি ঘোষণা পরে গত ১০ মার্চ ৪২৯ নং স্বারকের আদেশমূলে তাকে বিআরটিএ’র সিরাজগঞ্জ সার্কেলে বদলি করে কর্তৃপক্ষ তবে পছন্দ না হওয়ায় বিআরটিএ’র এই আদেশটি মানেননি নুর মোহাম্মদ তোয়াহা। কৌশলে ১৯ মার্চ ৪৮৮ নং স্বারকের আদেশে পূর্বের আদেশ বাতিল করেন।

গণপরিবহন সেক্টরের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ, এক সময়ে দালালদের আঁতুড়ঘর ছিল সংস্থাটি। তবে বর্তমানে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছু। দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টা করে বাহিরের দালাল নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলেও কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষমতার দাপট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বিআরটিএ। 

এই বিষয়ে জানতে বিআরটিএর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সার্কেলে সহকারী পরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী মান্নান এর মোবাইল ফোনে কল দিলে সংযোগ পাওয়া যায়নি।