ঈদযাত্রায় ভোগান্তি কমছে না সমন্বয়হীনতায়

Passenger Voice    |    ০১:৫৩ পিএম, ২০২২-০৪-২৮


ঈদযাত্রায় ভোগান্তি কমছে না সমন্বয়হীনতায়

উৎসব উপলক্ষে বিশ্বে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের যাতায়াত হয় চীনে। প্রতি বছর নববর্ষ বা বসন্ত উৎসবের সময় দেশটির প্রায় ১৫ কোটি মানুষ অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গন্তব্যে ভ্রমণ করেন। ফলে উৎসবের আগে-পরে সড়ক, রেল, নৌ, আকাশ—সব পথেই বাড়ে যাত্রীর চাপ। তবে এজন্য যাত্রাপথে ভোগান্তিতে পড়তে হয় না দেশটির নাগরিকদের। উৎসবের বাড়তি যাত্রীর চাপ অবকাঠামো বাড়িয়ে নয়, সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামাল দিচ্ছে চীন।

ঈদ উৎসবে ইন্দোনেশিয়ার প্রায় নয় কোটি মানুষ যাতায়াত করবে। নাগরিকদের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে মহাসড়ক, স্টেশন ও বন্দরগুলোয় প্রায় ১৪ হাজার জরুরি চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করেছে দেশটির সরকার। ছোট ছোট যানবাহনে যাতায়াত নিরুৎসাহিত করতে বিপুলসংখ্যক যাত্রীকে দেয়া হচ্ছে বিনামূল্যে যাতায়াত সুবিধা। এসব উদ্যোগের ফলে ঈদযাত্রায় খুব একটা সমস্যায় পড়ে না ইন্দোনেশিয়ার মানুষ।

বাংলাদেশেও গতকাল থেকে শুরু হয়েছে ঈদযাত্রা। যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো বলছে, এবার ঈদে ঢাকা ছাড়বে প্রায় সোয়া কোটি মানুষ। ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করতে গিয়ে এরই মধ্যে এক দফা দুর্ভোগে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। ২০-২২ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে কেউ টিকিট পেয়েছে, কেউ ফিরেছে খালি হাতে। সহজ ছিল না অনলাইনে টিকিট কেনাও। ঈদযাত্রার প্রথম দিন গতকাল নির্ধারিত সময়ের পর কমলাপুর ছেড়েছে বেশ কয়েকটি ট্রেন। এমন প্রেক্ষাপটে সামনের দিনগুলোতে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে যাত্রীরা।

ঈদে দেশের মানুষ সবচেয়ে ভোগান্তিতে পড়ে সড়কপথে। ভয়াবহ যানজটে পড়ে ১০-১২ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে সময় লেগে যায় ৩০ ঘণ্টা পর্যন্ত। বিশৃঙ্খল সড়ক-মহাসড়কে প্রতি ঈদেই বেড়ে যায় সড়ক দুর্ঘটনা। প্রাণ হারায় শত শত মানুষ। আবার যানবাহন না পেয়ে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, থ্রি-হুইলারসহ বিভিন্ন ছোট যানবাহনে দূরের গন্তব্যে যেতে বাধ্য হয় নিম্ন আয়ের মানুষ। নৌপথ থাকে যাত্রীতে টইটম্বুর। সড়ক ও নৌ—দুই পথেই ঈদের সময় যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় হয় বাড়তি ভাড়া। একই অবস্থা আকাশপথেও।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ঈদযাত্রার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। এর জন্য দেশের বিশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের বিদ্যমান যোগাযোগ অবকাঠামো দিয়েই মানুষের ঈদযাত্রার কষ্ট অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। চীনের উৎসব যাত্রার ব্যবস্থাপনার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, উৎসবের সময় কী পরিমাণ মানুষ ভ্রমণ করতে পারে, তার একটা তথ্যভাণ্ডার তৈরি করেছে চীন। ফলে কোন মাধ্যমে কত মানুষ যাতায়াত করতে পারে তা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেশটির পরিবহন সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কাছে রয়েছে। যাত্রীর চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই তারা পরিবহন ব্যবস্থাপনাটি করে। পাশাপাশি ঈদের সময় ছোট গাড়ি চলাচলে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে চীন। ফলে উৎসবের সময় যাত্রীর চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও সেখানে যানজট হয় না।

বাংলাদেশে যাত্রীর চাহিদা নিরূপণ করে সেই যাত্রীর চাপ সামাল দেয়ার জন্য উদ্ভাবনী পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি আরো বলেন, সড়ক নির্মাণকারী দপ্তরগুলোর দায়িত্ব হলো সড়ককে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত রাখা। চার বা আট লেনের চওড়া সড়ক তৈরি করলেই যে সেই সড়কে বেশি যানবাহন চলতে পারবে বিষয়টি এমন নয়। প্রয়োজন হাটবাজারমুক্ত, প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত মহাসড়ক। যে সড়কে গাড়ি চলতে গিয়ে কোথাও বাধার মুখে পড়বে না। একইভাবে রেলপথে যাত্রীর চাপ সামাল দেয়ার জন্য দোতলা কিংবা তিনতলা ট্রেন প্রবর্তন করা যেতে পারে। বহুতল নৌযানও যাত্রীর চাপ সামলাতে পারে। তবে অপরিকল্পিতভাবে সেতু নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশে বহুতল নৌযান চলাচলের সুযোগ অনেকটাই নষ্ট করে ফেলা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

এবারের ঈদযাত্রায় প্রতিদিন ১৪ লাখ মানুষ পরিবহন সংকটে পড়তে পারেন বলে জানিয়েছেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। পরিবহন সংকটে পড়া মানুষকে ট্রেনের ছাদ, লঞ্চে ওভারলোড, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থায় যাতায়াত করতে হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। ঈদে উৎসবে যাতায়াতে ভোগান্তির সমাধান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যাত্রীদের এ ভোগান্তি এড়ানোর সুযোগ খুব কম। যেসব মানুষ ঢাকা ছাড়বেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের যদি ঈদযাত্রার আগেই গন্তব্যে পাঠিয়ে দেয়া যায়, তাহলে আপাতত সমস্যার কিছুটা সমাধান হতে পারে। তবে ঈদে যাত্রী ভোগান্তির স্থায়ী সমাধান হিসেবে ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের কোনো বিকল্প নেই বলে মত দেন তিনি।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও খাতসংশ্লিষ্টরা এবারের ঈদযাত্রায় চরম মাত্রায় যাত্রী ভোগান্তির আশঙ্কা করলেও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ সামাল দিতে সরকার প্রস্তুত। মঙ্গলবার এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে মন্ত্রী বলেন, আসন্ন ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক ভালো। সড়কের জন্য কোথাও যাতে কোনো জনদুর্ভোগ না হয় সেজন্য আমরা সতর্ক রয়েছি এবং মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মহানগরীর টার্মিনালগুলোয় শৃঙ্খলা রক্ষায় এবং যাত্রীদের সুবিধার্থে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স কার্যকর থাকবে এবং অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ন্ত্রণে মোবাইল কোর্টের নজরদারি থাকবে। ঈদের সময় অতিরিক্ত ভিড় এবং যাত্রীদের চাপ এড়াতে পোশাক কারখানাগুলো একদিনে ছুটি না দিয়ে ধাপে ধাপে ছুটি দেয়ার জন্য বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান ওবায়দুল কাদের।

সূত্র: বণিক বার্তা