মহাসড়কে মহাযন্ত্রণা সরকারি তিন ভবন

Passenger Voice    |    ১০:৩৯ এএম, ২০২২-০৪-২৫


মহাসড়কে মহাযন্ত্রণা সরকারি তিন ভবন

রাজধানীর বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি থেকে মহাখালী ফ্লাইওভার। এই পথটুকু ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়কের শেষ অংশ। ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করলে প্রথম অংশ। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, মহাসড়কটি এখানে এসে একটু বাঁক নিয়ে হঠাৎই সরু হয়ে গেছে। সেখানে প্রায় সব সময়ই লেগে থাকে যানজট। ফুটপাতও সরু। কারণ, সেখানে রাস্তার জায়গায় গড়ে উঠেছে সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন তিনটি প্রতিষ্ঠানের তিনটি বহুতল ভবন- পাঁচতলাবিশিষ্ট ঢাকা সড়ক বিভাগের কার্যালয়, ১৫ তলা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ভবন এবং ১০ তলা সেতু ভবন। ভবন তিনটির কারণে রাস্তা প্রশস্ত করার সুযোগও নেই। ফলে এ মহাসড়কে চলাচলকারী গাড়িগুলো ফ্লাইওভারের মুখে গিয়ে জমা হয়। যেসব গাড়ি ফ্লাইওভারে উঠবে সেগুলোকেও আটকে থাকতে হয়। এই যানজট কখনও কখনও বনানী ফ্লাইওভার পর্যন্ত দীর্ঘ হয়।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বছর দেড়েক আগে এক অনুষ্ঠানে রাস্তার জায়গায় গড়ে তোলা সেতু ভবন ও বিআরটিএ ভবনটি অপসারণের দাবি জানান। তিনি বলেন, 'বনানীতে বিমানবন্দর সড়কের পাশে গড়ে তোলা সেতু ভবন ও বিআরটিএ ভবনের কারণে ওই এলাকায় যানজট তৈরি হচ্ছে। সে কারণে ভবন দুটি অপসারণ করতে হবে। ওই ভবন দুটি ওখানে গাড়ির গতি কমিয়ে দিচ্ছে। যারা ওখানে এটি করেছেন, তারা পরিকল্পনা অনুযায়ী করেননি।'

এর পর থেকেই আতিকুল ইসলাম ভবন দুটি অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু অপসারণ তো হয়ইনি, উল্টো ওই দুটি ভবনের পাশে নতুন করে তৈরি হয়েছে ঢাকা সড়ক বিভাগের কার্যালয়। সেটি এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে।

ভবনগুলো অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বলে উল্লেখ করেছেন আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'কাউকে না কাউকে ভুল ধরিয়ে দিতে হবে। ওখানে সব সময় যানজট লেগে থাকে। পূর্বাচল প্রকল্প চালু হলে তখন কী অবস্থা হবে? এ জন্য বিষয়টি জানিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে; কিন্তু তারা কোনো উত্তর দেয়নি। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ আরও অনেককে জানাব।'

সংশ্নিষ্টরা জানান, অতীতে প্রায় একইভাবে গড়ে উঠেছিল বিজয় সরণির ২৩তলা র‌্যাংগস ভবন।

আদালতের আদেশের পর সেখান থেকে ভবনটি অপসারণ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। বর্তমানে সেখানে তৈরি হয়েছে তেজগাঁও ওভারপাসের সংযোগ সড়ক। পরে প্রায় একইভাবে হাতিরঝিল দখল করে তৈরি হয়েছিল বিজিএমইএ ভবন। ২০১১ সালে আদালত সেটি অপসারণের নির্দেশ দিলে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে সেটা ভেঙে অপসারণ করা হয়। ওই ভবনটি ভাঙার অন্যতম কারণ ছিল, বিজিএমইএ ভবনের কারণে হাতিরঝিলের পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। কিন্তু তার চেয়ে বেশি যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেতু ভবন ও বিআরটিএ ভবন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সেতু বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী ফেরদৌস আহমেদ কথা বলতে অনাগ্রহ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন চাইলে ভাঙতে পারে। আমরা কিছু বলব না।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদারের দপ্তরে গেলে জানানো হয়, তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন। সংস্থার পরিচালক (প্রশাসন) আজিজুল ইসলামের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলার পরামর্শ দেন চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সচিব আ. রাজ্জাক। আজিজুল ইসলামকে বিষয়টি অবহিত করার পর তিনিও কথা বলতে রাজি হননি। তিনি সংস্থাটির পরিচালক (সড়ক নিরাপত্তা) শেখ মাহবুব ই রাব্বানীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। মাহবুব রাব্বানী বলেন, 'বিআরটিএ বা সেতু ভবনের কারণে যানজট হচ্ছে- এ কথা ঠিক নয়। জাহাঙ্গীরগেট থেকে মহাখালী ফ্লাইওভারের মুখেও যানজট হয়। সেখানে কি সেতু ভবন বা বিআরটিএ ভবন আছে?'

মাহবুব রাব্বানীর ভাষ্য, এসব ভবন করার আগে কমিটি করা হয়েছিল। তারা সরকারের প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে রিপোর্ট দিয়েছিল, এখানে বিআরটিএ ভবন করলে কোনো কিছু বাধাগ্রস্ত হবে না। তার পরই এ ভবন করা হয়েছিল। এর পরও যদি সরকার মনে করে, র‌্যাংগস বা বিজিএমইএ ভবনের মতো এগুলো ভেঙে ফেলবে, সেটা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। এখানে বিআরটিএর কিছু বলার নেই।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, এ ধরনের সড়কের পাশে কিছু জায়গা রেখে দেওয়া হয়, যাতে ভবিষ্যতে রাস্তা প্রশস্ত করার প্রয়োজন হলে ব্যবহার করা হয়। না হলে সেখানে সবুজায়ন করা হয়, যাতে সার্ভিস রোডের প্রয়োজন হলে তৈরি করা যায়। সে জন্যই মহাখালী থেকে টঙ্গী পর্যন্ত সড়কের পাশে এ রকম জায়গা রাখা হয়েছিল। কিছু স্থানে তা এখনও আছে।

ড. আদিল বলেন, বিআরটিএ, সেতু ও সড়ক ভবন সম্পূর্ণ অবৈধভাবেই গড়ে উঠেছে। একটা কিছু করতে হলে মাস্টারপ্ল্যানের সঙ্গে সমন্বয় রেখেই করতে হয়। এখানে সেটা করা হয়নি। সরকারি কর্তৃপক্ষের একে অপরের মধ্যে যে সমন্বয়হীনতা, এটা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের মহাসড়ক আইনেও রয়েছে, মহাসড়কের ১০ মিটারের মধ্যে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। এই আইন লঙ্ঘন করলে কারাদাণ্ডের বিধান রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান তিনটি এ আইনও লঙ্ঘন করেছে।

যেভাবে গড়ে ওঠে: বঙ্গবন্ধু (যমুনা) সেতু তৈরির পর এর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৯৯৮ সালে তৈরি হয় সেতু ভবন। তখন যমুনা সেতু কর্তৃপক্ষ ভবন হিসেবে পরিচিতি পায় ভবনটি। পরে যমুনা সেতুর কার্যক্রম সরিয়ে নেওয়া হয়। তখন ভবনটি থেকে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। পরে পদ্মা বহুমুখী সেতুর কার্যক্রম শুরু হলে ভবনটি কেবল সেতু বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। নামকরণ হয় সেতু ভবন।

একইভাবে স্বাধীনতার পর গণভবনের পাশে একটি ভবনে চলত বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ের কার্যক্রম। বছর দশেক পর সেটা স্থানান্তর করা হয় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পাশে এলেনবাড়িতে। ২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সেতু ভবনের পাশে বিআরটিএ ভবন নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। নির্মাণকাজ শেষ হলে ১ নভেম্বর ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিআরটিএ ভবনের উদ্বোধন করেন।

বিআরটিএ ভবনের পাশে ২০২০ সালে ঢাকা সড়ক বিভাগের ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। খুব শিগগির সেখানে শুরু হতে যাচ্ছে ঢাকা সড়ক বিভাগের কার্যক্রম।

এ বিষয়ে সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, 'আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। এ বিষয়ে মন্ত্রী মহোদয় বলতে পারেন। আমি কথা বলতে পারি না।'

বনানী-মহাখালী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় তিন একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে সেতু ভবন। সামনে আছে গাড়ি পার্কিংয়ের কিছু স্থান। আছে ক্যান্টিনসহ আরও কিছু স্থাপনা। প্রায় একই রকম আয়তনের ওপর তৈরি হয়েছে বিআরটিএ ভবন। এর পাশেই কিছুটা কম আয়তনের জায়গায় গড়ে উঠেছে ঢাকা সড়ক বিভাগ ভবন। এর উত্তর দিকের কিছু অংশ বেড়া দিয়ে ঘেরা। আর রাস্তার পাশের কিছু অংশ ছেড়ে রাস্তা প্রশস্ত করে তৈরি করা হয়েছে বনানী চেয়ারম্যানবাড়ি ইউটার্ন। ইউটার্ন থেকে মহাখালী পর্যন্ত দেখা যায় যথারীতি তীব্র যানজট।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ঢাকা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টের অধীনে ঢাকা মাস্টারপ্ল্যান ১৯৫৮-এর পরিকল্পনা অনুযায়ী মহাখালী জনস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রবেশমুখ থেকে মহাখালী মোড় হয়ে বনানী রেলক্রসিং পর্যন্ত পূর্ব পাশের সড়কটি ৮০-৯০ ফুট প্রশস্ত করে সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ জন্য তৎকালীন 'সিঅ্যান্ডবি'-এর মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল ভবিষ্যতে যাতে দুই সড়ক থেকে আসা যানবাহনের গতি অক্ষুণ্ণ রেখে মহাখালী-বনানী করিডরকে গতিশীল রাখা যায়। কিন্তু সেই জায়গায় রাস্তা সম্প্রসারণ না করে সরকারি সংস্থাই একের পর এক ভবন তুলেছে। যাকে কাস্টডিয়ান (অভিভাবকত্ব) দিলেন সে-ই যদি খেয়ে ফেলে, তাহলে আপনি যাবেন কোথায়?

তিনি বলেন, 'এই ভবনগুলো রাখার কোনো সুযোগ নেই। এগুলো ভাঙতেই হবে। পাশাপাশি মহাখালী থেকে বনানী রেল ক্রসিং পর্যন্ত লম্বা যে জায়গায় কিছু দোকানপাট ও মার্কেট আছে, সেটাকেও এখন অধিগ্রহণ করতে হবে। ঢাকার উত্তর-দক্ষিণের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বাঁচাতে হলে এ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।'

সূত্র: সমকাল