টানেলের সুফলের বদলে সংকট, যানজট বাড়ার শঙ্কা

Passenger Voice    |    ১০:৫৬ এএম, ২০২১-১১-০১


টানেলের সুফলের বদলে সংকট, যানজট বাড়ার শঙ্কা

চট্টগ্রাম শহরে নিরবচ্ছিন্ন ও যুগোপযোগী সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি বিদ্যমান ব্যবস্থার আধুনিকায়নে কর্ণফুলী নদীতে নির্মাণ হচ্ছে বঙ্গবন্ধু টানেল। এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ, ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে নতুন পথ তৈরি, চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দরসহ আশপাশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলাও প্রকল্পটির অন্যতম উদ্দেশ্য। কর্ণফুলী নদীর তলদেশের এ টানেলের দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার। দুই পাশে তৈরি হচ্ছে পাঁচ কিলোমিটারের সংযোগ সড়ক। প্রকল্পটির কাজ যখন শেষের দিকে, তখন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ বলছে, ভবিষ্যতে যানবাহনের চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত নয় এ সংযোগ সড়ক ও সড়কের অবকাঠামো। ফলে টানেলের সুফলের বদলে চট্টগ্রামে যানজট আরো বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

বঙ্গবন্ধু টানেলের ট্রাফিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, প্রতি বছর ৭ শতাংশের বেশি হারে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচলে প্রবৃদ্ধি হবে। এ হিসাবে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন পারাপার হওয়া যানবাহনের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩৮ হাজার। ২০৪০ সালে তা ৬২ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। আর প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার যানবাহন চলাচল করবে ২০৬০ সাল নাগাদ। যে হারে যানবাহনের সংখ্যা বাড়বে, বিদ্যমান অবকাঠামো দিয়ে তার চাপ সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

টানেলের বর্তমান ট্রাফিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম থেকে টানেল পার হয়ে প্রথমে পতেঙ্গা বিচ রোড, এরপর আউটার রিং রোড দিয়ে যানবাহনগুলো ফৌজদারহাটের দিকে যাবে। অন্যদিকে নবনির্মিত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিমানবন্দর সড়ক ও নগরীর মূল সড়ক দিয়ে টানেলের সংযোগ সড়কে প্রবেশ করবে যানবাহন। নগর পরিকল্পনাবিদ ও সিএমপির ট্রাফিক বিভাগ মনে করছে, একটি টানেলের সুষ্ঠু ব্যবহারে সংযোগকারী সড়কগুলো হতে হবে সরল ও পরিকল্পনামাফিক। কিন্তু বিদ্যমান টানেল নির্মাণ প্রকল্পের সংযোগ সড়কের সঙ্গে সংযোগকারী বিভিন্ন পয়েন্টের যে নকশা রয়েছে, তাতে টানেলের সুফল পাওয়ার পরিবর্তে সংকট তৈরি হবে। যানজটের কারণে যানবাহন দ্রুত সময়ের মধ্যে টানেলে প্রবেশ করতে না পারলে সময়ক্ষেপণ হবে। পাশাপাশি টানেলের প্রবেশাধীন একাধিক এলাকা থেকে আসা যানবাহনের চাপে চট্টগ্রাম শহরের ভেতরেই যানজট প্রকট আকার ধারণ করবে।

এ সম্পর্কে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, নগরীর বাইরের যানবাহন আউটার রিং রোড দিয়ে টানেলে আসা-যাওয়া করবে। কিন্তু এ আউটার রিং রোড দিয়েই পতেঙ্গা টার্মিনাল-ইপিজেডসহ অন্যান্য গাড়ি চলাচল করার পরিকল্পনাও রয়েছে। ফলে সড়কটিতে যানবাহনের কী পরিমাণ চাপ বাড়বে তার কোনো ধারণা নেই প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের। টানেলের জন্য সুনির্দিষ্ট একাধিক সংযোগ সড়ক না করে জোড়াতালি দিয়ে নকশা প্রণয়ন করলে টানেল ব্যবস্থাপনা নতুন সংকটের মধ্যে পড়বে বলে শঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি।

গত ২২ সেপ্টেম্বর সেতু বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীক টানেলের নির্মাণকাজ পরিদর্শনে যান। সে সময় তাকে এসব বিষয় অবহিত করেন সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর। ট্রাফিক পরিকল্পনার বিষয়টি আমলে নিয়ে এরপর সেতু বিভাগের সচিব ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেন। এ কমিটিকে টানেলের উভয় প্রান্তে ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ কমিটির মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে আরো দুটি কারিগরি উপকমিটি গঠন করা হয়েছে।

টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে ফকিন্নির হাট, কেইপিজেড, চাতুরী বাজার ও টানেলের সংযোগ সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচলে নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্ন করতে চারটি সড়কে ইউলুপ নির্মাণের প্রস্তাব করেছে এসব কারিগরি কমিটি। এর বাইরে সংযোগ সড়কের দুই পাশে দুটি ইউটার্ন, আনোয়ারা এলাকার পারকি সৈকত সড়ক, টোল প্লাজা, সিইউএফএল-চাতুরী সড়ক ও মেরিন একাডেমি রোড প্রশস্তকরণ, পতেঙ্গা প্রান্তে গোল চত্বর এলাকায় সংযোগ সড়ক, নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সড়ক, আউটার রিং রোড এলাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থা নিশ্চিতে ওভারপাস ও বাইপাস সড়ক নির্মাণ, বিচ, রিং রোড ও এয়ারপোর্ট রোডের পাশে যানজট কমানোর জন্য পর্যাপ্ত পার্কিং স্পেস, আন্ডারপাস নির্মাণ ও ফুটওভার ব্রিজ তৈরির সুপারিশও করেছে।

নতুন করে টানেলের ট্রাফিক পরিকল্পনার নকশা তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ প্রকল্পের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক হাবিবুর রহমানকে। নকশা প্রণয়নকাজের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে নকশা প্রণয়ন করে জমা দেব। আশা করছি টানেল নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই এসব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে।

অন্যদিকে সিএমপির পক্ষ থেকে বিষয়গুলো নিয়ে একটি জরিপ করা হয়েছে। জরিপের পর ইউলুপ নির্মাণ, আন্ডারপাস-ওভারপাস নির্মাণ, ওজন স্কেল স্থানান্তর, টানেলের দুই প্রান্তে পূর্ণাঙ্গ দুটি থানা স্থাপন, ট্রাফিক অফিস স্থাপন, ডাম্পিং স্টেশন, রেকার ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনা তৈরি করেছে সিএমপি। পরিকল্পনার বিষয়গুলো গঠিত কমিটিকেও অবহিত করেছে সংস্থাটি।

চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু টানেলের ট্রাফিক পরিকল্পনার বিষয়ে সিএমপির পক্ষ থেকে যেসব আপত্তি ও সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখার কথা জানিয়েছেন সেতু বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীক। তিনি বলেন, সেখানে কিছু বিষয় আছে, যেগুলো আমরা বাইরে থেকে গিয়ে ঠিক করে ফেলতে পারব না। তাই টানেল এলাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে পরিকল্পনা তৈরির জন্য সিএমপি কমিশনারকে আহ্বায়ক করে আমরা একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। কমিটি কাজও শুরু করেছে। যেসব জটিলতার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো আসলে কোনো একক সংস্থার পক্ষে সমাধান করা কঠিন। চট্টগ্রামের উন্নয়নের সঙ্গে যেসব সংস্থা জড়িত, সবার সঙ্গে সুষ্ঠু একটা সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনার কাজগুলো এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। নতুন ট্রাফিক পরিকল্পনা ও অবকাঠামো তৈরির ব্যয়ভার সেতু কর্তৃপক্ষ বহন করবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, টানেলকে ঘিরে সব অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে সেতু কর্তৃপক্ষের জায়গার ওপর। সেখানে আমরা সহজ ও নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থার পাশাপাশি কর্ণফুলী টানেল এলাকাকে নান্দনিকভাবে গড়ে তুলতে চাই।

সূত্র: বণিক বার্তা