কাজ করে না সিগন্যাল বাতি, রাজধানীতে ট্রাফিক ব্যবস্থা চলছে হাতের ইশারায়

Passenger Voice    |    ০৫:০০ পিএম, ২০২১-০৯-০৯


কাজ করে না সিগন্যাল বাতি, রাজধানীতে ট্রাফিক ব্যবস্থা চলছে হাতের ইশারায়

দেশজুড়ে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া লাগলেও তার কোনও প্রতিফলন নেই রাজধানী ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়। ঢাকার দুই  সিটি করপোরেশন এলাকায় ১১০টি সিগন্যাল পয়েন্টের মধ্যে কতটি সচল রয়েছে- তা বলতে পারবেন না কেউই। সিগন্যাল পোস্ট থাকলেও বেশিরভাগে বাতি জ্বলে না। আবার দু-একটিতে জ্বললেও সে অনুযায়ী গাড়ি চলে না, চলতে দেওয়া হয় না। সবুজ বাতি জ্বলেছে, কিন্তু গাড়ি চলছে না, কারণ ট্রাফিক পুলিশ হাত তুলে থামিয়ে রেখেছে।  

রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের কথা বলা হচ্ছিল এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। সরকারের প্রথম মেয়াদের শুরুতে, ২০০৯ সালে রাজধানীর ৭০টি স্থানে ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি বসানো হয়। এরপর ২০১৪ সালে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৫টি ট্রাফিক সিগন্যাল ইন্টারসেকশনে টাইমার কাউন্টডাউন বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরীক্ষামূলক ৩৫টি স্থানে বসানোও হয়। সেসব এখন কেবলই স্মৃতি, ব্যর্থতার ইতিহাস। শুধু গুলশানের দুটি ইন্টারসেকশন ছাড়া নগরীর আর কোথাও স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যালের অস্তিত্ব নেই। সব জায়গাতেই সিগন্যাল পরিচালিত হচ্ছে হাতের ইশারায়। তবে স্বয়ংক্রিয় এবং টাইমার কাউন্টডাউন সিগন্যালগুলো হারিয়ে গেছে কার ইশারায় তা জানা যায়নি।

স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল চালু না হওয়া পিছনে সিটি করপোরেশন ও ট্রাফিক পুলিশের বিরোধের কথা বারবার শোনা গেছে। ট্রাফিক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এসব বাতি সক্রিয় নাকি নিষ্ক্রিয় তা জানা নেই। তারা বলেন, ‘আমরা শুধু ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছি। বাকি সব সিটি করপোরেশনের হাতে। একটি বাতি নষ্ট হলেও তাদের শরণাপন্ন হতে হয়।’ আবার দুই সিটি করপোরেশন থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে সিগন্যাল বাতি যথাযথভাবে ব্যবহার না করার। 

একটি সূত্র জানিয়েছে, কিছু দিন আগে মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার সমন্বয়ে একটা জরিপ করা হয়। তাতে দেখা গেছে, সিগন্যাল বাতির ৭০ ভাগই অকার্যকর হয়ে আছে। এছাড়া রাস্তার উন্নয়ন এবং অন্যান্য কাজের কারণে অনেক জায়গায় সিগন্যাল বাতির সরঞ্জাম খুলে রাখা হয়েছে। রাস্তায় এসব কর্মকাণ্ড যতদিন না ঠিক হচ্ছে এবং নতুন সিগন্যাল বাতি যতদিন পর্যন্ত বসানো না হবে, পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হবে না।

সপ্তাহ খানেক রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ জায়গায় সিগন্যাল বাতির কোনও কার্যকারিতা নেই।  দু-এক জায়গায় বাতি জ্বললেও কোনও নিয়ম-নীতি নেই। কোথাও বাতি জ্বলছে তো জ্বলছেই, পরিবর্তন আর হচ্ছে না। আর যেখানে পরিবর্তন হচ্ছে, সেখানে বাতির সিগন্যাল বাতিল হচ্ছে দায়িত্বরত পুলিশের হাতের ইশারা।

বিজয় সরণি মোড়ে পুলিশ হাতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন। রোদ-বৃষ্টিতে পুলিশ এভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। সেখানে প্রতিটি যানবাহনকে পুলিশের হাতের ইশারার অপেক্ষায় থাকতে হয়। ভুক্তভোগীদের মতে, ম্যানুয়াল পদ্ধতির কারণে যানজট আরও বাড়ছে।

মহাখালী থেকে মোহাম্মদপুরের দিকে যাওয়া আরিফ হোসেনের সঙ্গে কথা হয় বিজয় সরণি মোড়ে। তিনি জানান, প্রতিদিন এই পথে যাতায়াত করেন। সব সময় এই সিগন্যালে আটকা পড়তে হয়। মাঝে মাঝে ৫-১০ মিনিট পর্যন্ত থমকে থাকতে হয়। এখানে কোনও নিয়মনীতি নেই। নেই নজরদারিও। ইচ্ছামতো তারা সিগন্যাল চালাচ্ছেন।

কথা হয় বিজয় সরণি মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা যত ডিজিটালাইজেশনই করা হোক, নগরবাসী সচেতন না হলে কিছুই সফল হবে না। আমাদের আইন মানার প্রবণতা অনেক কম।’  

মিরপুর থেকে নিউ মার্কেট যাচ্ছিলেন রেজাউল করিম। যানজট ঠেলে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে এসে আবারও আটকে যান তিনি। বলেন, ‘কী ভয়ানক যানজটে আটকা পড়ে আছি। সিগন্যাল বাতি রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর কার্যকারিতা নেই। ট্রাফিক পুলিশ হাতের ইশারায় দায়িত্ব পালন করছেন। এতে যানজট আরও বাড়ছে। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনা থাকলে নির্দিষ্ট সময়ে আমরা পার হতে পারতাম। এখন  তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।  

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মুনিবুর রহমান চৌধুরী বলেন, ট্রাফিক ডিজিটালাইজেশনের বিষয়ে নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। এর আলোকে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কী রকম হবে তা নিয়েও কাজ চলছে। এটা বাস্তবায়ন কিংবা শেষ হতে বেশ  সময় লাগতে পারে। সিটি করপোরেশন এবং এই কাজে যারা জড়িত, সবার সমন্বয়ে কীভাবে পরবর্তী ধাপগুলো শেষ করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। ডিজিটালাইজেশনের সুবিধা যাতে নগরবাসী পায় তা আমাদের নজরে রয়েছে।

তেজগাঁও বিভাগের ট্রাফিক উপ-পুলিশ কমিশনার সাহেদ আল মাসুদ বলেন, সিগন্যাল বাতিগুলোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। এগুলো মেরামত করে বুঝিয়ে দিলে আমরা শুধু পরিচালনার দায়িত্বে থাকবো। আমরা এখনও বাতিগুলো বুঝে পাইনি। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী সরেজমিন বিভিন্ন সিগন্যাল বাতি পর্যবেক্ষণ করে দেখছি। তারপর পরিদর্শন করে দেখছি কোনটা নষ্ট কোনটা ভালো, কোনটার রিমোট আছে কোনটার নেই। এখন যেসব জায়গায় সিগন্যাল বাতি কার্যকর রয়েছে, তা পরিচালনার জন্য কোনও চাবি কিংবা বক্স হ্যান্ডওভার করেনি সিটি করপোরেশন। এগুলো পেলে আমরা চালানো শুরু করবো। আমাদের কাজ শুধু ব্যবহার করা।

তিনি আরও বলেন, ‘যানজট কমাতে সমন্বয় থাকতে হবে। ভালো রাস্তা দরকার, ভালো যানবাহন দরকার; ডিজিটাল সিস্টেম যেমন দরকার। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে মানুষের সচেতনতা থাকা দরকার। মানুষের আইন মানার প্রবণতা বাড়াতে হবে। আবার দায়িত্বরতদের থাকতে হবে সচেতনতা। এসব ঠিক হলেই আমরা ট্রাফিক ডিজিটালাইজেশনের সুফল পেতে শুরু করবো।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ উত্তরের যুগ্ম কমিশনার আবু রায়হান মুহাম্মদ সালেহ বলেন, রাস্তায় দায়িত্বে থাকা পুলিশ হাতের ইশারায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার তিনটি পার্টি হয়েছে। একটি ইঞ্জিনিয়ারিং, দ্বিতীয়টি এডুকেশন এবং তৃতীয়টি এনফোর্সমেন্ট। আমরা এনফোর্সমেন্টটা দেখি।  

গুলশান ২ নম্বরের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেখানে সিগন্যাল বাতি চালু হয়েছে। ফিঙ্গারিংয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এছাড়া যেখানে লাইট জ্বলে, সেখানে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তবে অনেক জায়গায় সিগন্যাল বাতির এক লাইট জ্বললে অন্যটি জ্বলছে না। আবার অনেক জায়গায় বাতি অকেজো হয়ে আছে। ডিজিটালাইজেশনের বিষয়ে সরকার ইতিবাচক। তবে এটি হতে সময় লাগবে।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন